আল মাহমুদ বিপ্লব
মায়ের সাদা কাফন
(৩০ শে জুলাই,২০১৮ ইং, সুবহে সাদিকের সময় আমার প্রিয় মা চলে যায় চিরতরে।তাঁরই স্মরণে নিচের লেখাটি। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি প্রিয় জননীকে)
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦
অনেকদিন আগে ইউটিউবের ইসলামিক সংগীতের একটি চ্যানেল থেকে নিচের গানটি শুনেছিলাম, মায়ের কথা মনে পড়ার সাথে সাথে গানটি আবারও মনে পড়লো-
"পৃথিবীর একপাশে মাকে রেখে,
অন্য পাশেও মাকে রাখি।
পৃথিবীর সব কথা ভুলে গিয়ে,
ব্যাকুল প্রাণে মাকে ডাকি।
জীবনের সবখানে, সবগানে,
মাকে ছাড়া জীবনের নেই মানে।
মা হীন এলোমেলো হৃদয়ে,
আর কোন ঠিকানা কেউ কি জানে।"
সত্যি! মা ছাড়া কেউ মনের কথা বুঝে না,বুঝতে পারে না। মানুষ মরণশীল।এটা মেনে নিতেই হবে।সবকিছু কবরস্থ করা যায় না।
কিছু কিছু মৃত্যুর বেদনা ভুলা যায় না।
আমি সবাইকে ভুলতে পারলেও,সব স্মৃতি ভুলতে পারলেও, আমার মায়ের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোকে কোনোদিনই ভুলতে পারবো না। আমার মায়ের সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে । সেসব স্মৃতির পাতা থেকে কিছু লেখা আপনাদের সাথে শেয়ার করে মনটাকে হালকা করতে চাই। আমি কেন মায়ের জন্য এতো পাগল তা নিচের কয়েকটি ঘটনা পড়লেই বুঝতে পারবেন।
#আমার মনে পড়ছে একদিন মা বলেছিল, আমার বড় ভাই ১৯৮৫ সালে মারা যাওয়ার পর মা ভূমিষ্ট করে দুটি মেয়ে ,তারপর ৪ বছর পর আমাকে ও ৭ বছর পর ছোটবোনকে ভূমিষ্ট করে । আমি ভূমিষ্ট হওয়ার আগে মা মান্নত করে বলেছিল,"আমার আবার একটি ছেলে হলে যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আল্লাহর কাছে সপ্তাহে ১ টি করে নফল রোযা পালন করবো।
কথায় নয় বাস্তববিকভাবে তা করেছিল, মা আমার জন্য দীর্ঘ ২৫ টি বছরের প্রতিটি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দিন নফল রোযা পালন করেছে।
মাকে বলতাম,মাগো এত রোদ্রে রোযা রেখো না,শরীর খারাপ করবে,মা হেসে বলতো আরে বোকা ছেলে কিচ্ছু হবে না।বলতো এ নিয়ে তুই ভাবিস না,ঠিক মতো পড়াশোনা কর।
#আমাদের একসময় ভালো আর্থিক অবস্থা ছিল।পরে অভাবের সংসার হয়,
যার কারণে আমাদের চার ভাইবোনদের সব চাহিদা বাবা পূরণ করতে পারতো না। মা অনেক কিছু ত্যাগ করে আমাদের সব চাহিদা পূরণ করতো।
মনে পড়ে ২০০৩ সালে একদিন বায়না ধরেছিলাম- আমাকে মকমলের কাপড় কিনে দিতে হবে, না হলে স্কুলে যাবো না।সেসময় মকমলের কাপড় অনেক দামী ছিল। সেটার দাম ছিল ৩৮০০ টাকার মতো।
বাবাকে বলা মাত্রই বলেছিল, চুপ থাক,বেশি প্যাঁচাল পারবি না।টাকা নাই দিতে পারমু না।
মা তা দেখে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল,আমি মকমল কাপড় কিনে দিবো তোকে, স্কুলে যাওয়া বাদ দিবি না। সত্যি! মা,সেদিন ছাগল বিক্রি করে আমাকে মকমলের কাপড় কিনে দিয়েছিল। অথচ মায়ের পরনে তেমন ভালো কাপড় ছিল না।আমি বলেছিলাম,মাগো! তুমি একটা কাপড় কিনে নিয়ো।মা বলেছিল,আমার অনেক কাপড় রয়েছে।নিজের জন্য কোনদিন ভালো কোনো কাপড় কিনেনি।যা করতো সব আমার জন্য।মাঝেমধ্যে জোর করে নতুন কাপড় কিনে দিতাম। আজো মায়ের দেওয়া মকমলের কাপড়টি যত্ম রেখে দিয়েছি। দেখামাত্রই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।
#মা শিখিয়েছে ধার্মিকতা।
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি আল্লাহ ও রাসুল, মসজিদ,নামাজ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতাম না।
মা আমাকে কুরআন তেলওয়াত শিক্ষা দিয়েছিল। আমি একটু জেদি ছিলাম, টাকা ছাড়া স্কুলে যেতাম না। মা বলতো,নামাজ পড়লে ফেরেস্ততারা সদাই খেতে টাকা দেয়।নামাজ পড়ার পর জায়নামাজের নিচে মা পাঁচ টাকা রেখে দিতো, যেন নামাজ পড়ি।আমি পরে বুঝেছি যে মা টাকা রেখে দিয়েছিল।
মাগো! আমি সত্যি! ধন্য যে তুমি আমাকে নামাজী বানিয়েছো।
#মা আমাকে শিখিয়েছিল মানবতাবোধ।উদ্ধুদ্ধ করেছে মানব হিতৈষী কাজে।একদিন বালিজুড়ি হাইস্কুল মাঠে একজন পাগলির মৃত দেহ পড়েছিল। তার সর্বাঙ্গে ছিল পোকা, দেহ ঘায়ে ভরা। কেউ তাকে গোসল করাতে চাইলো না।আমি সেদিন দেখেছিলাম আমার মা নিজহাতে পাগলটিকে গোসল করায়ে নিজ হাতে কাফনের কাপড় পড়িয়ে দেয়।অনেকেই তাকে হেলা করতে শুরু করে।মা বলতো,আমি ঠিক কাজ করেছি,এরকম সবারই করা উচিত।আমাকে বলতো,যখনই কারো বিপদ দেখবি সাধ্যানুযায়ী পাশে দাঁড়াবি।মাগো! আমি তোমার নিকট থেকে মানবতাবোধের বাস্তব চিত্র শিখেছি।
#আমার মায়ের দুটি বিশেষ গুণ ছিল, তিনি সুস্বাদু রান্না তৈরি ও অপরকে মেহমানদারিতে পরিতৃপ্ত হতেন।
।এমন নারী এ সমাজে এখনো কি আছে ?
আমি মনে করি তেমন নেই। আমার মা এজন্য সবার চেয়ে অনন্য ছিল। আমার মা এজন্য সবার মন জয় করেছিল।
এরকম হাজারো স্মৃতির পিরামডি তৈরি করে চলে গেলো মা।
পৃথিবীতে একটি নাম মা। নামটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য ও গভীরতা অনেক বেশি।
যে নামে রয়েছে অমৃত সুধা। যে নামের প্রশংসার কথা অবিরত লিখলেও শেষ হবে না।যে নামের দোয়ায় প্রভুর কাছে রয়েছে সফলতা ।
যে নামের বদদোয়ায় রয়েছে বিফলতা।
এ জীবনের সফলতা,বিফলতা নির্ভর করে পিতামাতার দোয়ার উপর। পৃথিবীতে প্রতিটি পিতামাতা তার সন্তানের নিকট মহাদামী সম্পদ।
এ সম্পদ দুটির যারা পরিপূর্ণ হক আদায় করে তারাই প্রকৃত সন্তান।পৃথিবীর বুকে পিতামাতার প্রতি সন্তানদের ভালবাসা ভিন্ন হলেও, সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালবাসা অভিন্ন।সন্তানের ভালবাসা লোক দেখানো হতে পারে,কিন্তু পিতামাতার ভালবাসা নিষ্কলুষ। মাতাপিতার দুজনের মধ্যে মায়ের মর্যাদা বেশি। কেননা,মা সন্তানকে পেটে ধারণ করে, কষ্ট ভোগ করার পর প্রসব করে, তারপর অনেক প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে সন্তানকে গড়ে তুলে। পৃথিবীতে সেই তো হতভাগ্য যার মা নেই। আমিও তেমন একজন হতভাগ্য।
★৩০/৭/১৮ ইং আমার জীবনে একটি বেদনাবিধুর তারিখ, সেই তারিখের রাত-২:৩০ ঘটিকার সময় আমাদের চার ভাইবোনকে কাঁদিয়ে মা চিরদিনের জন্য চলে যায় না ফেরার দেশে। মা,অনেকদিন যাবত তিনটি কঠিন মরণব্যাধিতে ভুগছিল,কিন্তু মুখ খুলে তা বলেনি। যখন তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে একদম অসহ্য হয়ে উঠেছিল তখন তিনি রোগের কথা বলেন। ততক্ষণে রোগ তিনটি নিরাময়ের বাইরে চলে গিয়েছিল। তারপরেও তা শুনামাত্রই আমরা তাকে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করা শুরু করি। মাদারগঞ্জ, জামালপুর,বগুড়া,ঢাকার নামকরা হাসপাতালসহ আরো অনেক জায়গায় নিয়ে যায়। এসব প্রতিটি জায়গায় আমার বড় বোন,মেঝো বোন,হাকিম ভাই, এরশাদ ভাই, রিক্তা ভাবি ও বড় মামীর ভূমিকা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
যাহোক,যেখানেই গিয়েছি প্রচুর টাকা খরচ আর চিকিৎসার নামে টেষ্ট বাণিজ্যে পড়েছি। কিন্তু রোগীর তেমন ট্রিটমেন্ট তারা করেনি।যা করেছে ডাক্তারেরা তা দ্বারা ওরা টাকা লুটে নিয়েছে। ডাক্তারেরা যে কি পরিমাণ মানবতাবিরোধী তা বুঝতাম না, যদি বিপদে না পড়তাম।সর্বশেষে মাকে নিয়ে গেলাম বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ চিকিৎসালয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ১ মাস থাকার পর একেরপর এক টেষ্ট করা শেষ করে তারা ফাইনাল রির্পোট দিলো যে, আমার মা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার বাঁচার সম্ভাবনা নেই। ডাক্তারেরা রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে দিলো । দৌড়াদৌড়ি ও অনেক টাকা খরচ,ত্যাগ-তিতিক্ষা করেও কোনরুপ কাজ হলো না। ব্যর্থ মনোরথে মাকে আগের তুলনায় আরো বেশি মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে এলাম। প্রচন্ড ব্যথায় মা তখন ছটফট করছে। অজস্র মানুষ মায়ের জন্য দোয়া করলো। তাঁর অসুস্থতা আরো তীব্র হতে লাগলো এক পর্যায়ে কথায় বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিলো , এমন পরিস্থিতেও তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করে দিলো।
চার ভাইবোনকে একত্রিত করে সবাইকে শেষ আদর করে দিলো আর বাকি সময় আল্লাহু নামের জিকির করতে করতে চললো তিনটি দিন। এক পর্যায়ে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল পরপারে। আমাদের ভাইবোনকে চির ইয়াতীম করে চলে গেল মা। চোখের সামনে ছটফট করে মা মারা গেল, চার ভাইবোন তেমন কিছুই করতে পারলাম না। এখানে সবাই অসহায়, নির্বাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কেননা,বিধাতার বিধান, না মেনে কোন উপায় নাই। শেষ বিদায় জানিয়ে মাকে রেখে এলাম নির্জন নিরালায় একলা অন্ধকার ঘরে। মা আর কোনদিন আমাকে ভাত খেতে ডাকবে না আর খোঁজ নিবে না। মা যে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে চলে গেল নিরব অভিমানে। মাগো,আমাদের চার ভাই-বোনকে মাফ করে দিয়ো, তোমার জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না। তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম বিধাতার বিধানের কাছে। এ এক নিঃসীম বেদনা।
মায়ের সাদা কাফন
(৩০ শে জুলাই,২০১৮ ইং, সুবহে সাদিকের সময় আমার প্রিয় মা চলে যায় চিরতরে।তাঁরই স্মরণে নিচের লেখাটি। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি প্রিয় জননীকে)
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦
অনেকদিন আগে ইউটিউবের ইসলামিক সংগীতের একটি চ্যানেল থেকে নিচের গানটি শুনেছিলাম, মায়ের কথা মনে পড়ার সাথে সাথে গানটি আবারও মনে পড়লো-
"পৃথিবীর একপাশে মাকে রেখে,
অন্য পাশেও মাকে রাখি।
পৃথিবীর সব কথা ভুলে গিয়ে,
ব্যাকুল প্রাণে মাকে ডাকি।
জীবনের সবখানে, সবগানে,
মাকে ছাড়া জীবনের নেই মানে।
মা হীন এলোমেলো হৃদয়ে,
আর কোন ঠিকানা কেউ কি জানে।"
সত্যি! মা ছাড়া কেউ মনের কথা বুঝে না,বুঝতে পারে না। মানুষ মরণশীল।এটা মেনে নিতেই হবে।সবকিছু কবরস্থ করা যায় না।
কিছু কিছু মৃত্যুর বেদনা ভুলা যায় না।
আমি সবাইকে ভুলতে পারলেও,সব স্মৃতি ভুলতে পারলেও, আমার মায়ের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোকে কোনোদিনই ভুলতে পারবো না। আমার মায়ের সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে । সেসব স্মৃতির পাতা থেকে কিছু লেখা আপনাদের সাথে শেয়ার করে মনটাকে হালকা করতে চাই। আমি কেন মায়ের জন্য এতো পাগল তা নিচের কয়েকটি ঘটনা পড়লেই বুঝতে পারবেন।
#আমার মনে পড়ছে একদিন মা বলেছিল, আমার বড় ভাই ১৯৮৫ সালে মারা যাওয়ার পর মা ভূমিষ্ট করে দুটি মেয়ে ,তারপর ৪ বছর পর আমাকে ও ৭ বছর পর ছোটবোনকে ভূমিষ্ট করে । আমি ভূমিষ্ট হওয়ার আগে মা মান্নত করে বলেছিল,"আমার আবার একটি ছেলে হলে যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আল্লাহর কাছে সপ্তাহে ১ টি করে নফল রোযা পালন করবো।
কথায় নয় বাস্তববিকভাবে তা করেছিল, মা আমার জন্য দীর্ঘ ২৫ টি বছরের প্রতিটি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দিন নফল রোযা পালন করেছে।
মাকে বলতাম,মাগো এত রোদ্রে রোযা রেখো না,শরীর খারাপ করবে,মা হেসে বলতো আরে বোকা ছেলে কিচ্ছু হবে না।বলতো এ নিয়ে তুই ভাবিস না,ঠিক মতো পড়াশোনা কর।
#আমাদের একসময় ভালো আর্থিক অবস্থা ছিল।পরে অভাবের সংসার হয়,
যার কারণে আমাদের চার ভাইবোনদের সব চাহিদা বাবা পূরণ করতে পারতো না। মা অনেক কিছু ত্যাগ করে আমাদের সব চাহিদা পূরণ করতো।
মনে পড়ে ২০০৩ সালে একদিন বায়না ধরেছিলাম- আমাকে মকমলের কাপড় কিনে দিতে হবে, না হলে স্কুলে যাবো না।সেসময় মকমলের কাপড় অনেক দামী ছিল। সেটার দাম ছিল ৩৮০০ টাকার মতো।
বাবাকে বলা মাত্রই বলেছিল, চুপ থাক,বেশি প্যাঁচাল পারবি না।টাকা নাই দিতে পারমু না।
মা তা দেখে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল,আমি মকমল কাপড় কিনে দিবো তোকে, স্কুলে যাওয়া বাদ দিবি না। সত্যি! মা,সেদিন ছাগল বিক্রি করে আমাকে মকমলের কাপড় কিনে দিয়েছিল। অথচ মায়ের পরনে তেমন ভালো কাপড় ছিল না।আমি বলেছিলাম,মাগো! তুমি একটা কাপড় কিনে নিয়ো।মা বলেছিল,আমার অনেক কাপড় রয়েছে।নিজের জন্য কোনদিন ভালো কোনো কাপড় কিনেনি।যা করতো সব আমার জন্য।মাঝেমধ্যে জোর করে নতুন কাপড় কিনে দিতাম। আজো মায়ের দেওয়া মকমলের কাপড়টি যত্ম রেখে দিয়েছি। দেখামাত্রই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।
#মা শিখিয়েছে ধার্মিকতা।
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি আল্লাহ ও রাসুল, মসজিদ,নামাজ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতাম না।
মা আমাকে কুরআন তেলওয়াত শিক্ষা দিয়েছিল। আমি একটু জেদি ছিলাম, টাকা ছাড়া স্কুলে যেতাম না। মা বলতো,নামাজ পড়লে ফেরেস্ততারা সদাই খেতে টাকা দেয়।নামাজ পড়ার পর জায়নামাজের নিচে মা পাঁচ টাকা রেখে দিতো, যেন নামাজ পড়ি।আমি পরে বুঝেছি যে মা টাকা রেখে দিয়েছিল।
মাগো! আমি সত্যি! ধন্য যে তুমি আমাকে নামাজী বানিয়েছো।
#মা আমাকে শিখিয়েছিল মানবতাবোধ।উদ্ধুদ্ধ করেছে মানব হিতৈষী কাজে।একদিন বালিজুড়ি হাইস্কুল মাঠে একজন পাগলির মৃত দেহ পড়েছিল। তার সর্বাঙ্গে ছিল পোকা, দেহ ঘায়ে ভরা। কেউ তাকে গোসল করাতে চাইলো না।আমি সেদিন দেখেছিলাম আমার মা নিজহাতে পাগলটিকে গোসল করায়ে নিজ হাতে কাফনের কাপড় পড়িয়ে দেয়।অনেকেই তাকে হেলা করতে শুরু করে।মা বলতো,আমি ঠিক কাজ করেছি,এরকম সবারই করা উচিত।আমাকে বলতো,যখনই কারো বিপদ দেখবি সাধ্যানুযায়ী পাশে দাঁড়াবি।মাগো! আমি তোমার নিকট থেকে মানবতাবোধের বাস্তব চিত্র শিখেছি।
#আমার মায়ের দুটি বিশেষ গুণ ছিল, তিনি সুস্বাদু রান্না তৈরি ও অপরকে মেহমানদারিতে পরিতৃপ্ত হতেন।
।এমন নারী এ সমাজে এখনো কি আছে ?
আমি মনে করি তেমন নেই। আমার মা এজন্য সবার চেয়ে অনন্য ছিল। আমার মা এজন্য সবার মন জয় করেছিল।
এরকম হাজারো স্মৃতির পিরামডি তৈরি করে চলে গেলো মা।
পৃথিবীতে একটি নাম মা। নামটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য ও গভীরতা অনেক বেশি।
যে নামে রয়েছে অমৃত সুধা। যে নামের প্রশংসার কথা অবিরত লিখলেও শেষ হবে না।যে নামের দোয়ায় প্রভুর কাছে রয়েছে সফলতা ।
যে নামের বদদোয়ায় রয়েছে বিফলতা।
এ জীবনের সফলতা,বিফলতা নির্ভর করে পিতামাতার দোয়ার উপর। পৃথিবীতে প্রতিটি পিতামাতা তার সন্তানের নিকট মহাদামী সম্পদ।
এ সম্পদ দুটির যারা পরিপূর্ণ হক আদায় করে তারাই প্রকৃত সন্তান।পৃথিবীর বুকে পিতামাতার প্রতি সন্তানদের ভালবাসা ভিন্ন হলেও, সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালবাসা অভিন্ন।সন্তানের ভালবাসা লোক দেখানো হতে পারে,কিন্তু পিতামাতার ভালবাসা নিষ্কলুষ। মাতাপিতার দুজনের মধ্যে মায়ের মর্যাদা বেশি। কেননা,মা সন্তানকে পেটে ধারণ করে, কষ্ট ভোগ করার পর প্রসব করে, তারপর অনেক প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে সন্তানকে গড়ে তুলে। পৃথিবীতে সেই তো হতভাগ্য যার মা নেই। আমিও তেমন একজন হতভাগ্য।
★৩০/৭/১৮ ইং আমার জীবনে একটি বেদনাবিধুর তারিখ, সেই তারিখের রাত-২:৩০ ঘটিকার সময় আমাদের চার ভাইবোনকে কাঁদিয়ে মা চিরদিনের জন্য চলে যায় না ফেরার দেশে। মা,অনেকদিন যাবত তিনটি কঠিন মরণব্যাধিতে ভুগছিল,কিন্তু মুখ খুলে তা বলেনি। যখন তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে একদম অসহ্য হয়ে উঠেছিল তখন তিনি রোগের কথা বলেন। ততক্ষণে রোগ তিনটি নিরাময়ের বাইরে চলে গিয়েছিল। তারপরেও তা শুনামাত্রই আমরা তাকে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করা শুরু করি। মাদারগঞ্জ, জামালপুর,বগুড়া,ঢাকার নামকরা হাসপাতালসহ আরো অনেক জায়গায় নিয়ে যায়। এসব প্রতিটি জায়গায় আমার বড় বোন,মেঝো বোন,হাকিম ভাই, এরশাদ ভাই, রিক্তা ভাবি ও বড় মামীর ভূমিকা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
যাহোক,যেখানেই গিয়েছি প্রচুর টাকা খরচ আর চিকিৎসার নামে টেষ্ট বাণিজ্যে পড়েছি। কিন্তু রোগীর তেমন ট্রিটমেন্ট তারা করেনি।যা করেছে ডাক্তারেরা তা দ্বারা ওরা টাকা লুটে নিয়েছে। ডাক্তারেরা যে কি পরিমাণ মানবতাবিরোধী তা বুঝতাম না, যদি বিপদে না পড়তাম।সর্বশেষে মাকে নিয়ে গেলাম বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ চিকিৎসালয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ১ মাস থাকার পর একেরপর এক টেষ্ট করা শেষ করে তারা ফাইনাল রির্পোট দিলো যে, আমার মা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার বাঁচার সম্ভাবনা নেই। ডাক্তারেরা রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে দিলো । দৌড়াদৌড়ি ও অনেক টাকা খরচ,ত্যাগ-তিতিক্ষা করেও কোনরুপ কাজ হলো না। ব্যর্থ মনোরথে মাকে আগের তুলনায় আরো বেশি মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে এলাম। প্রচন্ড ব্যথায় মা তখন ছটফট করছে। অজস্র মানুষ মায়ের জন্য দোয়া করলো। তাঁর অসুস্থতা আরো তীব্র হতে লাগলো এক পর্যায়ে কথায় বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিলো , এমন পরিস্থিতেও তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করে দিলো।
চার ভাইবোনকে একত্রিত করে সবাইকে শেষ আদর করে দিলো আর বাকি সময় আল্লাহু নামের জিকির করতে করতে চললো তিনটি দিন। এক পর্যায়ে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল পরপারে। আমাদের ভাইবোনকে চির ইয়াতীম করে চলে গেল মা। চোখের সামনে ছটফট করে মা মারা গেল, চার ভাইবোন তেমন কিছুই করতে পারলাম না। এখানে সবাই অসহায়, নির্বাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কেননা,বিধাতার বিধান, না মেনে কোন উপায় নাই। শেষ বিদায় জানিয়ে মাকে রেখে এলাম নির্জন নিরালায় একলা অন্ধকার ঘরে। মা আর কোনদিন আমাকে ভাত খেতে ডাকবে না আর খোঁজ নিবে না। মা যে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে চলে গেল নিরব অভিমানে। মাগো,আমাদের চার ভাই-বোনকে মাফ করে দিয়ো, তোমার জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না। তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম বিধাতার বিধানের কাছে। এ এক নিঃসীম বেদনা।