শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৯

আঁধারে রুপা -সাহিদ আহামেদ জিবন


দ্বিতীয় পর্ব
সোহান জাগ্রত হয়েই বলতে লাগলো কে তোমি?
কোথায় থেকে এসেছো এখানে কেন?
উত্তর দিচ্ছো না কেন?
শনশন বাতাসের সাথে উড়ে আসা কাশফুলের খসড়া শুকনো ফুলের অংশ রুপার কর্ণপাতে  স্পর্শ হতেই রুপা তাড়াহুড়া করে জেগে উঠে অচেনা কিশোরের সামনে থেকে দৌড়ে বাড়িতে চলে যায়। এই চলে যাওয়া  সেই চলে যাওনা নয় সোহানের বুকে মধ্যে যেন পূবালীর বাতাসে প্রেমের ঢেউ বইছে ।এক ফালি দেখার রুপার চেহেরা যেন নানা সুখের রূপ ধারণ করে আকাশের রংধনুকেও হার মানিয়ে সোহানের বুকে ভেসে উঠছে একটা বৃহৎ প্রেমের রংধনু। আকাশের রংধনু তার সাময়িক সময় ফুরিয়ে গেলে সবই শেষ কিন্তু রুপার চেহেরায় যে রংধনু সোহানের বুকে উঠেছে সেটা যেন আর অদৃশ্য হচ্ছে না বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে রুপার রূপকে। কল্পনায় চলে দিন,  দিনের পর মাস তবুও সোহান রুপার প্রতি আরও অস্থির হয়ে যাচ্ছে ।
একদিন সেই নদীর পাড়ে একই যায়গায় রুপাকে দেখে সোহান এগিয়ে যায় রুপা তার উড়নাটি দিয়ে মুখ ঠেকে রেখে সোহানের হাজার প্রেম আর্জি  কথা শুনে রুপা চলে যেতে চাইলে সোহান তার নমনীয় হাতটি শক্তি করে চেপে ধরে বলে,
সোহান : ঐই দিন যখন দেখেছি তোমায় হারিয়েছিলাম এতদিন তোমার মাঝেই আজ তোমি এখানে একা আমি তোমার সঙ্গী হতে এসেছি তোমার একাকীত্ব অবসান করতে এসেছি তোমার একাময় জীবনের সুখ টেনে আনার জন্য আমার অতৃপ্ত হৃদয়ের বাগানের শত শতাব্দীর ধরে জন্ম নেওয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্নেহ মায়া মমতার ভালোবাসার বিন্দু গুলো একত্রিত হয়ে আজ তোমাকে প্রেম নিবেদন করছে
রুপা :আপনি কেন এমন করে কথা বলছেন?
আপনার কথা গুলো শুনে যেন আমার বুকের শক্ত প্রেমের দেওয়ালটি ভেঙ্গে ভালোবাসা বেরিয়ে যাচ্ছে ।
কেন আপনার কথা আমাকে এতো দূর্বল করে তুলে?  আপনার কথার বাঁকে আমি হারিয়ে যায় বারবার মিশে যেতে চাই আপনার সাথে ।সোহান আরেকটু কাছে আসুন বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে থাকে ।বুকের অদ্রি সমান ভালোবাসা দিয়ে আরও কাছে পেতে চাই।
সোহান :রুপা শুনো আজ. ...........

বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

যতীনের জুতো

যতীনের জুতো

সুকুমার রায়
যতিনের বাবা তাকে এক জোড়া জুতো কিনে দিয়ে আচ্ছা করে শাসিঁয়ে কইলেন, “এইবারে যদি জুতো ছেঁড়ো, তাহলে ছেঁড়া জুতোই পড়ে থাকতে হবে।”
প্রতি মাসে যতিনের নতুন জুতোর দরকার হয়। তার জামা কিছুদিন যেতে না যেতেই ছিঁড়ে যায়। সে সব কিছুতেই উদাসীন। তার সব বই এর মলাট ছেঁড়া, কোনাগুলো মোড়ানো, স্লেটের আদ্যপান্ত চীড় ধরা। তার হাত থেকে চক পেন্সিল পড়ে পড়ে সেগুলো আর আস্ত নেই একটিও। তার আর একটি বদ অভ্যেস হল, পেন্সিলের গোড়া কামড়ানো। এই কারণে পেন্সিলের গোড়া গুলো দেখতে বাদামের ছিবড়ে ছাড়ানো খোসার মত হয়ে গেছে। তার ক্লাসের পন্ডিত মশাই সেগুলো দেখে বলেন, “আজ বাড়িতে ভাত খাও নি বুঝি!”
নতুন জুতো নিয়ে কিছুদিন যতিন বেশ সাবধানে চলাফেরা করল; ধীরে ধীরে সিঁড়ি থেকে নামে, দরজার বেড়ী সাবধানে ডিঙ্গোয়, সদা সতর্ক থাকে যেন হোঁচট না খায়। কিন্তু অতটুকুই সার। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই পুরোনো যতিন। জুতোর মাহাত্য তার মনে থাকে না-সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নামা আর পাথরে হোঁচট খাওয়া নিত্য ব্যাপার। এক মাসের মধ্যে তার জুতোর সামনের দিক ছিঁড়ে গেল। যতিনের মা বললেন, “মুচি ডেকে এইবারে জুতোটা সেলাই করিয়ে নে, নইলে আর পড়তে পারবি নে।” কিন্তু মুচি ডাকা যতিনের কর্মের মধ্যে পড়ে না। ফল স্বরূপ জুতোর ছেঁড়া আরো বারতেই থাকে।
যতিনের যে একদমই কোনো কিছুর প্রতি দরদ নেই তা না, যে জিনিসটা যতিনের চিন্তা চেতনায় আছে সেটি হল তার ঘুড়ি। অতি যত্ন সহকারে সে ফাটা ঘুড়ি জোড়া লাগায় এবং যতদিন সম্ভব সেটি ওড়ানোর চেষ্টা করে। খেলার সময়টা তার বেশিরভাগই ঘুড়ি উড়িয়ে কাটে। এই ঘুড়ির কারণে তার রান্না ঘর হতে তাড়া খেতে হয়। ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে রান্না ঘরের আসে পাশে ঘুরঘুর করে, আঠা নেওয়ার জন্য। ঘুড়ির ল্যাজ লাগাতে হলে কিংবা কাঁচির দরকার হলে তার মায়ের সেলাই বাক্সের ওপর হামলা চলে। একবার ঘুড়ি ওড়াতে বের হলে নাওয়া খাওয়া তার মাথায় ওঠে। সেইদিন যতিন ইস্কুল থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি আসল। গাছে উঠতে গিয়ে নতুন জামাটা ছিঁড়ে ফেলেছে। বই খাতা রাখার পর সে পায়ে জুতো গলাতে গেছে-দেখে সেটি এমনি ছিঁড়ে গেছে যে সেলাইয়েরও অযোগ্য। কিন্তু সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ভাবনাটি তার মাথা থেকে বেমালুম হাওয়া! দু-তিন ধাপ সিঁড়ি একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগল। শেষতক তার জুতো জোড়ার দশা এমনি হল যে দেখলে মনে হবে বেচারা কষ্টে সব কটা দাঁত বের করে আছে। শেষ তিন ধাপ যেই সে নামতে যাবে, মনে হল যেন তার পায়ের তলায় আর মাটি নেই, ছেঁড়া জুতো তাকে শূন্যে ভাসিয়ে অজানা দেশে নিয়ে চলেছে।
যখন তার জুতো জোড়া থামল, যতিন চেয়ে দেখে কোন এক অজানা দেশে এসে সে পৌঁছেছে। অনেক মুচি এখানে ওখানে বসে আছে। যতিনকে দেখেই ছুটে এল তারা, তার জুতো জোড়া খুলে সাবধানে ঝাড়তে শুরু করে দিল। তাদের মধ্যে যে নেতা গোছের ছিল, যতিনকে বলল, “শুনেছি তুমি নাকি ভারি দুষ্টু? দেখ, কি করেছ জুতো জোড়ার হাল! দেখ, জুতো জোড়া তো মরমর আবস্থায় আছে!” ততক্ষণে যতিন একটু ধাতস্ত হয়েছে, বললে, “জুতোর কি প্রাণ আছে নাকি যে মরবে?” মুচি জবাব দিলে, “নয় ত কি? কি ভেবেছ হে বাপু? যখন দৌড়ে বেরাও তখন ত মনে থাকে না যে জুতো কষ্ট পায়, কিন্তু কষ্ট পায় বটে। সে কারনেই চিৎকার করে কাঁদে। যখন পড়িমড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে বেরাও, তখন পায়ের চাপে জুতোর পাশ ক্ষয়ে যায়। ঠিক এই কারনেই জুতো তোমাকে আমাদের কাছে এনেছে। আমরা এখানকার সব ছেলেদের জিনিসপত্রের দেখাশোনা করি। যখন তারা তাদের জিনিসের ঠিক মত দেখাশোনা করে না, তখন তাদের উচিত শিক্ষা দেই।” মুচি তার জুতো ফেরত দিয়ে বললে, “ঝট্‌পট্‌ সেলাই করতে লেগে পড় তো।” যতিনের খুব রাগ হল-তীব্র স্বরে বললে, “আমি জুতো সারাই না, মুচিরা সারায়।” মুচি মুচকি মুচকি হেসে বলে, “এটা কি মামাবাড়ি পেয়েছ? ভেবেছ যে বলবে করব না-ওমনি পার পেয়ে যাবে? এই নাও সুঁই আর সুতো-সেলাই করতে লেগে পড়।”
যতিনের রাগ ভয়ে পরিনত হয়ে গেছে ততক্ষণে। ভয়ে ভয়ে বললে, “কি করে সেলাই করতে হয় জানি নে।” মুচি বললে, “দেখাচ্ছি, কি করে করতে হয়।” যতিন ভয়ে ভয়ে বসল জুতো সেলাই করতে। হাতে সুঁই ফুটল, জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘার ব্যাথা হয়ে গেল-অনেক্ষণ চেষ্টা করে একপাটি জুতো মাত্র সারতে পেরেছে। তখন মুচির কাছে কেঁদে কেঁদে বল্ল, “আমি কালকে বাকিটা করব, খিদে পাচ্ছে খুব।” মুচি বলল, “কি বলছ বাপু! পুরো কাজ শেষ না করলে খেতেও পাবে না ঘুমুতেও পারবে না। ঐটে এখনও সেলাই করা বাকি আছে। ওটি শেষ করলে শিখতে হবে কিভাবে হাঁটতে হবে যাতে পরে জুতোর কষ্ট না হয়। তারপর দর্জির কাছে যেতে হবে-জামা সেলাই করতে। তারপর আমরা দেখব আর কি কি ভেঙ্গেছ।”
যতিনের চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। কোনো মতে দ্বিতীয় পাটি জুতো সারাল। ভগবানের অসীম দয়া, এটা এতটা বাজে ভাবে ছেঁড়েনি। তারপর মুচি তাকে এক পাঁচতলা বাড়িতে নিয়ে গেল। সেটাতে আবার সিঁড়ি মাটি থেকে সোজা ছাত পর্যন্ত। যতিনকে নিচে দাঁড় করিয়ে বললে, “একেবারে উপরে উঠে আবার নিচে নেমে এস ত দেখি। আর শোনো, একবারে একটা সিঁড়ির বেশি ভাংবে না।” যতিন কথা মতই সিঁড়ি ভাংল। মুচি বলল, “হল না, তিন বার দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গেছ, পাঁচ বার লাফিয়েছ, আর দু বার তিনটে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়েছ।” এতটা সিঁড়ি ভেঙ্গে যতিনের পা ব্যাথা করছিল। সে আর কোনো ছলচাতুরি করল না। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠল আর নামল। মুচি বল্ল, “এবার ঠিক হয়েছে, নাও এবার দর্জির কাছে চল।”
তারা একটা বিশাল মাঠের কাছে এল, সেখানে শুধু দর্জি আর দর্জি-বসে বসে সেলাই করে যাচ্ছে। তারা যখন যতিনকে দেখল বল্ল, “কি ছিড়েছ?” তার ধুতির দিকে তাকিয়ে কইল “ইকি! ভালো জায়গাটাই ছিঁড়েছ!” বিরক্তি ভরে মাথা নাড়িয়ে বল্ল, “ভারী অন্যায়, ভারী অন্যায়! চট্‌পট্‌ সেলাই কর এখন।” যতিনের না করার কোনো সাহস আর ছিল না। সে সুঁই সুতো নিয়ে সেলাই করতে বসে গেল। মাত্র দু ফোঁড় দিয়েছে-ওমনি দর্জি চেঁচিয়ে উঠল, “ইকি! একে তুমি সেলাই বল? আবার কর-আবার শুরু থেকে কর।” শেষতক যতিন আর পারল না-কেঁদেই ফেল্ল, “আমার খিদে পেয়ছে, আমি বাড়ি যাব। আমি আর কক্ষণ জামা ছিঁড়ব না, আর কক্ষণ ছাতা ভাংব না।” তার কথা শুনে সবাই হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগল, “খিদে পেয়েছে? আমাদের কাছে অনেক আছে খাওয়ার মত” বলে তারা যে পেন্সিল দিয়ে কাপড়ে দাগ কাটে সে সব কিছু এনে দিল। “পেন্সিল চিবোতে পছন্দ কর না! এই নাও এগুলো চেবাও বসে বসে। এছাড়া আর কিছু পাবে না।”
যতিন কে ওভাবে ছেড়েই তারা যে যার মত কাজে লেগে গেল। খিদে-তেষ্টায় মাঠে শুয়ে শুয়ে যতিন কাঁদতে লাগল। ঠিক সে সময়ে আকাশে কিছু একটা ফর্‌ফর্‌ করে উঠল-যে ঘুড়িটা যতিন যত্ন করে সাড়িয়েছিল, সেটি এসে তার কোলের কাছে পড়ল। ফিস্‌ ফিসিয়ে বল্ল, “তুমি আমার খুব যত্ন করেছ, সে কারনেই আমি তোমার সাহায্য করতে এসেছি। আমার লেজ ধর-শিগগিরি।” আর কথা না বাড়িয়ে যতিন ঘুড়ির লেজ ধরল। হুস্‌ করে ঘুড়ি তাকে আকাশে উঠিয়ে নিল। শব্দ শুনে দর্জিরা ছুটে এল, ঘুড়ির সুতো কাটার জন্য। আচমকা, যতিন ও তার ঘুড়ি গোঁত্তা খেয়ে আকাশ থেকে নামতে লাগল।
নামছে ত নামছেই-ঠিক যখন মাটিতে মাথা ঠেকব ঠেকব করছে তখনই, যতিন ধড়মড় করে উঠে বসল। ভগবান ই জানেন ঘুড়ির কি হল, যতিন দেখল সে শুয়ে আছে সিড়ির নিচে আর মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা।
কিছুদিন ভুগে, যতিন যখন সেরে উঠল, তার মা বললে, “সিঁড়ি থেকে পড়ে আমার যতিন খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর ছুটোছুটি করে না। একদম ছট্‌ফটানি নেই! তা না হলে তার জুতো চার মাস টেকে কি করে!”
সত্যি বলতে-যতিন মুচি আর দর্জিকে এখনো ভোলেনি।

রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৯

*** ভাঙ্গা পিয়ালা ***


                  এম.ড়ি শিমুল
পড়ার অনুরোধ রইলো। ভালো লাগবে আশা করি।
-----আমি যে দেশে থাকি, প্রথমই সে দেশের ভাষা দিয়েই শুরু করি। " UTHANDO " (উঠান্ডো) ইহা একটি দক্ষিণ আফ্রিকার খুবই জনপ্রিয় "JULU " শব্দ। এর আগে আমাকে বলতে হবে "JULU" কি?
----- "JULU " হচ্ছে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর নাম। আমি যতটুকু জানি পৃথিবীতে দ্বিতীয়তম বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে " JULU " সম্প্রদায়। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী গোষ্ঠীই হচ্ছে "JULU " গোষ্ঠী। আর এই "JULU " গোষ্ঠীর ভাষার নামই হচ্ছে "JULU " ভাষা। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশেই এই JULU ভাষা ব্যবহৃত হয়।
-----যে ভাষায়ও কথা বলতেন বিশ্বের বর্ণবাদী বৈষম্যের লড়াকু বীর(নবেল বিজয়ী) লেনসন্স ম্যান্ডেলা, নবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু, প্রেসিডেন্ট তামামবেগি ও দুইবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাকোব জুমা সহ আরো অনেকেই।
-----UTHANDO, একটি julu শব্দ। যে শব্দের ইংরেজি অর্থ হচ্ছে LOVE, আর বাংলা অর্থ হচ্ছে ভালোবাসা।
-----আমি আমার দীর্ঘ ১২ বছরে এ দেশের মানুষের মাঝে " Real love " বলতে যে শব্দটি আছে, তা কোথাও দেখিনি। এখানে আছে শুধু নগ্নতার উন্মাদনা। এখানে কে কতটা বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে শারীরিক উন্মাদনায় মেতে উঠতে পারে তারই বাহাদুরি চলে নিত্যনতুন। এদের সূত্র মতে, নিত্যদিন কেন একই জামা পড়তে হবে? জামার মতো জীবনসঙ্গীর পরিবর্তন চাই।
-----যে যতো গার্লফ্রেন্ড বা বউ নিয়ে বেশি সন্তান জন্ম দিতে পারবে সেই হয় পুরুষ! আর বাকি সবই যেন কাপুরুষ।
-----গেন্না ধরে গেছে এদের এমন চিন্তাভাবনা দেখে। দোকানে আসে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঠিকই, কিন্তু নজর পড়ে অন্য নতুন শরীরে। একহাতে ঠিকই গার্লফ্রেন্ডের একহাত ধরে রাখে, অন্যহাতে নতুনের নতুন হাত। ফোন নাম্বার নিতে হয়ে পড়ে ব্যাকুল তারা। আর ফোন নাম্বার পেলে তো সবই বাজিমাত। অবশ্য নিজের গার্লফ্রেন্ডটি তখন গর্বের সহিতই বলে, তার বয়ফ্রেন্ডটি একটি পুরুষ।
-----অনেকদিন আগে কবিগুছের একটি লোক প্রায়ই আমার দোকানে আসতো বেশকিছু ডাইরিগুছের খাতা হাতে নিয়ে।
-----আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি এইসব?
-----ও, কবি কবি ভাবে গর্বের সহিত আমায় বলেছিল, আমি কিছু লিখি। সমাজ ও সমাজের মানুষকে জাগাতে চেষ্টা করছি।
-----আমি বলেছিলাম, কি লিখিস?
-----ও, বলেছিল, পুরুষ কি? কাহাকে বলে?
-----আমি জানতে চাইতেই সাহিত্যিক ভাবে বলে, যে মানুষ উপার্জনক করে বেশি গার্লফ্রেন্ড বা বউ নিয়ে বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে সংসার চালাতে পারে সেই নাকি পুরুষ। আমি একজন লেখকের এমন চিন্তায় না হেসে পারিনি। এদের চিন্তার জগৎ টা কত ছোট্ট।
-----আমি সর্বতই দেখেছি এখানে হৃদয় ঘটিত কোন সম্পর্কই নেই। যা আছে তা যেন শুধুই শারীরিক। স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরাও এখানে একই রুমে রুমমেট হিসাবে থাকে রুমের ভাড়াটা সিয়ার করার জন্য। একই রুমে থেকে অবশ্য শারীরিক চাহিদাও সিয়ার করে রুমের ভাড়াটাও উসুল করে ফেলে। সেমিস্টার বা শ্রেণী বদলের সাথে সাথেই অবশ্য মানুষগুলোও বদলাতে ভুল করেনা তারা।
-----আমি এসব দেখে ঘৃণায় ভেবেছিলাম, এসবেই তাদের বসবাস। সবাই মনে হয় একই সুতায় গাঁথা। কিন্তু স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে যে কিছুটা ব্যতিক্রম থাকে তা প্রায় ভুলতেই বসেছিল আমি।
-----আজ একটি ঘটনায় আমার ১২ বছরের দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতাকে নিমিষেই মাটিচাপা দিয়ে চক্ষুকে খোলে দিয়ে গেলো।
-----আমি তখন ক্যাশ কাউন্টারে ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য টাকা হিসাব করতে ব্যস্ত। আমার বয়সী একজন নিগ্রো লোক ছলছল চোখে কাকুতি-মিনতি ভরা চোখে কিছু যেন বলতে চাচ্ছে আমায়।
-----আমি বললাম, কিছু বলতে চাস আমায়?
-----ও, বললো, হুম।
-----নতুন একটা ব্যাগ থেকে কি যেন একটা বের করবে এমন একটা ভাব। আমি অনেকটাই বুঝতে পেয়ে নাবোধক ইশারা করে বুঝিয়ে দিলাম যে, আমি নিবো না।
-----চোরের দেশ, এখানে প্রায়ই দোকানে কিছু না কিছু চোর তাদের চোরি করা জিনিস দোকানে বিক্রি করতে আসে। আমিও এমনটাই মনে করেছিলাম। আমি অবশ্য বরাবরই এসব থেকে দূরে থাকি। বলতে পারি, আমি অনেকটা ভয়েই থাকি এসব থেকে। বলতে পারেন, আমি একটা ভীতুরডিম। অবশ্য সস্তার যে দশ অবস্থা তা আমি মনে হয় ভালো করেই জানি।
-----ব্যাগ থেকে একটা ভাঙ্গা পিয়ালা বের করে আমাকে দেয়। আমি তো অবাক!
-----আমি বললাম, আজ বেশি খেয়েছিস নাকি (মদ)।
আমি এটা দিয়ে কি করবো?
-----ও, বলে, আমি এটা জোড়া দিতে চাই।
-----আমি বললাম, ওরে পাগল! একটা সুপারগ্লুর দাম পাচ Rand/ 35 taka. এরচেয়ে তো নতুনই একটা কিনতে পারবি।
-----ও, বলে, আমি এটাই জোড়া দিতে চাই।
------আমি পিয়ালাটা হাতে নিয়ে জোড়া দিয়ে দেখালাম। তাতে মনে হলো পুরোপুরিভাবে জোড়া লাগেনা। কিছু তো পান করা প্রশ্নই আসেনা।
-----আমি যখন পিয়ালাটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম, তখন হাতে যেন কিছু একটা আকাআকি উপলদ্ধি করতে পারছিলাম। আমি তখনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঐ আকাআকির মাঝে সুপ্তভাবে কি লুকিয়ে আছে?
-----ও, আমাকে বলে, তুই আমার এই ভাঙ্গা পিয়ালার সাথে অর্থের তুলনা করিস না। অর্থ দিয়ে এটার পরিমাপ করতে পারবিনা। এই ভাঙ্গা পিয়ালাটি আমার জীবনের চেয়েও দামী।
------ও, বলছিল আর চোখে অঝোর ধারায় জল ঝরাচ্ছিল। আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা। তাই ইশারাই বললাম, এটা বুঝি তোর ভীষণ স্মৃতির কারো দেওয়া পিয়ালা।
------ও কাদো কাদো ভাবে মাথা নাড়ছিল আর হাবোধক ইশারা করছিল। আমার ভিতরটা কেমন যেন মুচড় দিয়ে যাচ্ছিল ওর দিকে তাকিয়ে।
------আমি বললাম, এটা বুঝি তোর গার্লফ্রেন্ডের দেওয়া উপহার।
-----ওর মুখে একচিলতে হাসির রেখা অজান্তেই যেন ভেসে উঠেছিল, আবারো দমকা হাওয়ায় নিভু নিভু প্রদীপের মতো যেন আস্তে আস্তে নিভে গিয়ে কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। আমি যেন তাই দেখে বুঝতে পারার শেষসীমানা অতিক্রম করে ওর হৃদয়ে সব সুপ্ত কান্নার কারণ আবিষ্কার করে ফেললাম।
------আর বেশি কিছু বলতে পারিনি ওর চোখের জলের কাছে নিজের ভালোবাসার আবেগটাকে পরাজিত করে। তাই তো ভীষণ যত্ন করে পিয়ালাটা নিজ হাতে পরিষ্কার করে সুপারগ্লু দিয়ে সুন্দর করে জোড়া লাগিয়ে দেই। ওর হাতে দিতেই পিয়ালাটি বুকে জড়িয়ে ও মুখে নিয়ে চুমা খেয়ে হুহু করে কেদে উঠে অবুঝ শিশুর মতো।
-----আমি ক্যাশ কাউন্টার থেকে বাহিরে এসে ওকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম ও জানতে চাইলাম সবকিছু।
-----Kwanele is my love. Kwanele is my life. but she is not around my earth. ও, বলে আর কেঁদেকেটে একাকার হয়ে গেলো। ওর কান্নায় আমার ধূসর অনউর্বর বুকের জমিন যেন সহসায় করুণ এক কুয়াশায় ভিজিয়ে দিলো।
-----ও, আমাকে সুপারগ্লুর দাম দিয়ে যেন তাড়াতাড়ি আমায় থেকে পালাবার জন্য একপ্রকার মরিয়া হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম, ওর এখন ভীষণ চিৎকার করে কান্নার প্রয়োজন। যা আমার সামনে কাদতে পারছেনা। এমন অবস্থায় আসলে চিৎকার করে কান্নাটা ভীষণভাবে জরুরি। চিৎকার করে কাদতে পারলেই 'ও' একটু শান্তি পাবে। একটু নিজেকে হালকা করতে পারবে।
-----কিন্তু এইসব বিষয়ে বরাবরই আমার একটু আগ্রহ বেশি কাজ করে। তাই বেহায়া মনটাকে শাসনের বেড়ী পরিয়েও মানিয়ে রাখতে পারিনি। যদিও আমারো বুকের মাঝে একপ্রকার সুপ্ত কান্নারা তখন সারেগামা বাজানো শুরু করেছিল।
-----আমি ওকে বললাম, আমি টাকাগুলো নিবোনা। আমিও তোর ভালোবাসার স্মৃতির সাথে স্মৃতি হয়ে থাকবো বলে অনেক যত্ন করে পিয়ালাটি জোড়া লাগিয়েছি। আমিও যে ভালোবাসাকে তোর মতো ভীষণ সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তোর স্মৃতির সাথে আমাকেও নয় একটু অংশীদার করে নে। কিন্তু তখনো জানিনা আসল ঘটনাটা কি?
----- আমি ভাঙ্গা ও জোড়া দেওয়া পিয়ালাটার ছবি তুলে রাখি ভালোবাসার স্মৃতির নির্দেশন স্বরূপ। এইসব কিছু করতে পেরে ভালোবাসার নতুন কোন ভাস্কর্য তৈরি করতে পারিনি বলে মনে না হলেও আমি যে ভালোবাসার স্মৃতির জন্য একটা ভাঙ্গা পিয়ালা জোড়া দেওয়ার স্বাক্ষী রয়ে গেলাম এটাও কম কিসের?আমাকে নেহায়েত ছোট কিছু মনে হয়নি তখন।
-----আমি সবকিছু জানতে চাইলে 'ও' বলতে শুরু করে:
-----আমি Kwanele কে খুব ভালোবাসতাম। আমরা এই অসভ্য সমাজে একটু ব্যতিক্রমভাবে ভালোবেসে বাচতে চেয়েছিলাম। আমরা আসলেই ব্যতিক্রমই ছিলাম। এই তো সাত মাস আগেই ভালোবেসে আমাকে এই পিয়ালাটি উপহার দিয়েছিল। যাতে লেখা আছে,
            Kwanele
      [ Kwaen-el-uh]
noun: most awesome &
World's greatest lover.
----আমি ওর জীবনে বিশ্ব বিখ্যাত ভালোবাসার মানুষ হয়েই এক সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিধাতা তা চাইলেন না। গত ছয়মাস আগে এক কার এক্সিডেন্টে Kwanele চলে যায় পরপারে আমায় একা ফেলে। আমি প্রায় এই ছয়মাসই পাগলের মতো ছিলাম। আজই প্রথম একটু মনে হয় স্বাভাবিক হতেই টেবিলে এই পিয়ালাটি দেখে অনেক আদর করে নাড়াচাড়া করতে ছিলাম। হঠাৎই হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে যায়।
-----কথাগুলো বলছে আর হুহু করে কাদছে লোকটি। আমার মাঝেও যেন কান্নার এক ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
-----ও, বলে,
Kwanele আমাকে ডাকছে। আমি আসি। আমার যে আর বেশি সময় নাই। আমি প্রায় স্বপ্নে ওকে দেখি।
ও, আমাকে প্রতিনিয়ত ডাকে। Kwanele বলে,
" I am alone here,
but I am wait for you longtime.
when you come here?
 I have a bed of rose.
I have a haven here,
this haven is a haven of rose.
-----আমি যাই, আমি যাই! ও, আমাকে ভীষণভাবে ডাকছে তাই।


 চোখ মুছতে মুতছে পাগলের মতো দৌড়ে চলে যায় আমার সামনে দিয়ে। আমি চেয়ে থাকি ভালোবাসার পাগলপারা নিগ্রো মানুষটার চলে যাওয়া পথের শেষসীমানার আশায়।
-----আমার চোখ থেকে অজান্তেই অবাধ্য কয়েক ফুটা বাঁধভাঙ্গা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মাটির গায়। জানিনা, ভালোবাসার সম্মানে নাকি বিরহে গড়ায় আমার এ অশ্রুর? শুধু যে চোখের অশ্রুর গড়িয়ে পড়ার কথাছিল তাই পড়েছিল।
-----ভাবতেও অবাক লাগে, এই ভালোবাসার ভীষণ ক্ষরার দেশেও যে থাকতে পারে প্রকৃত প্রেমের প্রখর স্রোতধারা তা আমার জানা ছিল না।
-----মনেপ্রাণে সেলুট জানাই এমন প্রেমকে। তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়, "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়ায়ে দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন"।
আমি মনে হয় প্রেমের অমূল্য রতনের সঠিক সন্ধ্যানই পেয়ে ছিলাম।
----তাইতো আমার মতো চুনোপুঁটি হয়েও এই ভাঙ্গা পিয়ালা নিয়ে কিছু লিখার বৃথা চেষ্টা করলাম মাত্র।
বি: দ্র: ভালো লাগলে দয়া করে লাইক ও কমেন্ট করে আপনাদের এমন লেখা প্রতিনিয়ত উপহার দেওয়ার উৎসাহ প্রদান করলে আমি উপকৃত হবো।

এম.ড়ি শিমুল, জোহান্সেবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা।

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৯

‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’

‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (১)

এক বাদশার সাত ছেলে ছিল। অনেক আগের কথা। ছয় ছেলে ছিল এক মায়ের সন্তান। বাকি এক সন্তান ছিল অন্য মায়ের। বাদশা ওই ছেলের নাম রাখলো মালেক মুহাম্মাদ। এক রাতে বাদশা তাঁর প্রাসাদে আরামে ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুমের ভেতর চমৎকার এক স্বপ্ন দেখেন তিনি।
স্বপ্নটা হলো: বাদশার মাথার ওপরে ঝুলছে একটি সোনার খাঁচা। খাঁচার ভেতর বসে আছে চমৎকার একটা তোতা পাখি। ঘুম ভেঙে যাবার পর বাদশা চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবছিলো এই সোনার খাঁচার মানে কী কিংবা ওই তোতা পাখিরই বা কী অর্থ। অর্থ যা-ই হোক বাদশা কিন্তু ওই তোতা পাখির প্রেমে পড়ে গেছে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর থেকেই ভাবতে শুরু করেছে কী করে ওই তোতা পাখি আর সোনার খাঁচা হাতে পাওয়া যায়।
অপরদিকে বাদশা কিছুদিন থেকেই ভাবছিল বাদশাহির দায়িত্ব কোনো এক ছেলের হাতে সোপর্দ করবে যাতে তার অবর্তমানে বাদশাহি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না দেখা দেয়। স্বপ্ন দেখার পর বাদশা ভাবলো:ভালোই হলো। এবার সাত সন্তানকেই পরীক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সাত সন্তানের মধ্যে যে সন্তান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তার হাতে বাদশাহীর দায়িত্ব দিয়ে দেবে। বাদশা তাই তাঁর সাত সন্তানকেই ডেকে পাঠালো। সন্তানরা সবাই এসে পৌঁছলে বাদশা তাদের উদ্দেশে বললো: তোমরা সবাই আমার সন্তান। আমি তোমাদের সবাইকেই এক দৃষ্টিতে মানে সমানে চোখে দেখি। আমি বুঝতে পারছি না তোমাদের মধ্য থেকে কার হাতে এই বাদশাহির দায়িত্ব হস্তান্তর করবো। সেজন্যে তোমাদের সবাইকে একটা কাজ দেবো আমি। ওই কাজটা যে সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেবে তাকেই আমি আমার স্থলাভিষিক্ত করবো।
সবাই জানতে চাইলো: কাজটা কী!
বাদশা বললো: তোমরা আমার জন্য সোনার খাঁচায় বসে থাকা একটা তোতা পাখি নিয়ে আসবে। যে আনতে পারবে সে-ই হবে আমার পরবর্তী বাদশা।
একই স্ত্রীর পেটের ছয় ভাই বাদশার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো এবং একসাথে বেরিয়ে পড়লো সোনার খাঁচা আর তোতা পাখির সন্ধানে। অনেক দূর-দূরান্তে গেল তারা। শহর নগর গ্রাম গঞ্জ সবখানেই খুঁজলো। এমনকি নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশেও গেল। কত মানুষের কাছে যে জানতে চেয়েছে পথ কিংবা সোনার খাঁচা আর তোতা পাখির সন্ধান, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনো কাজেই আসে নি সেসব। অবশেষে খালি হাতেই ফিরতে হলো তাদের। ফিরে এসে বাদশাকে বললো: ‘হে বাদশা! আমরা সারা পৃথিবী ঘুরেছি,কিন্তু তুমি যে জিনিস চেয়েছো তা খুঁজে পাই নি’।

বলছিলাম ছয় ছেলে ফিরে এসে বাদশাকে তাদের অপারগতার কথা বললো। আর বাদশা মনে মনে ভাবলো: আমি কি এমনই কঠিন কোনো কাজ দিলাম ছেলেদেরকে যা করা তাদের জন্য অসম্ভব! এ রকম ভাবনার মাঝেই মালেক মুহাম্মাদ উঠে দাঁড়ালো এবং বললো: হে শ্রদ্ধেয় পিতা আমার! আপনি অনুমতি দিলে আমি ওই তোতা পাখি আর সোনার খাঁচার সন্ধানে যেতে চাই।
বাদশা বললো: ওরা ছয় জনই তোমার চেয়ে বড়। তারা একসাথে গিয়েও তোতা পাখি আর সোনার খাঁচা আনতে পারলো না আর তুমি একা গিয়ে কী করবে?
মালেক মুহাম্মাদ বললো: আল্লাহ চাইলে আনতেও তো পারি!
বাদশা বললো: ঠিক যেতে চাচ্ছো যখন যাও! যদি আনতে পারো, তাহলে বাদশাহি তোমার হাতে সোপর্দ করবো।
মালেক মুহাম্মাদ সফরের প্রস্তুতি নিয়ে কটি মণিমুক্তা সঙ্গে নিলো। এরপর দ্রুতগামী একটি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ছয় ভাইয়ের মধ্যে যে বড় সে ছিল ভীষণ হিংসুক। সে তার বাকি পাঁচ ভাইকে ডেকে বললো: আমি জানি মালেক মুহাম্মাদ তোতা পাখি আর সোনার খাঁচা আনতে পারবে। তাই চলো, ওর পেছনে পেছনে আমরাও যাই। বলা তো যায় না ও যদি আমাদের টেক্কা দিয়ে বসে! পাঁচ ভাই কথাটা মেনে নিলো এবং সবাই ঘোড়ায় চড়লো। যেতে যেতে একটা নির্জন প্রান্তরে গিয়ে মালেক মুহাম্মাদের নাগাল পেল। মালেক মুহাম্মাদকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে ছয় ভাই মিলে মারলো। মারতে মারতে মালেক ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মণিমুক্তাময় জিনটা তার মাথার পাশে রেখে দিলো যাতে মারা গেলে দাফন কাফনের ব্যবস্থা হয়। তারপর ছয় ভাইয়ের সবাই ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত পালিয়ে গেল যাতে কেউ তাদের দেখতে না পায়। মালেক মুহাম্মাদ সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটিতেই পড়ে ছিল। সে ঘুমের ভেতর হযরত আলি (আ) কে স্বপ্নে দেখতে পেল।
আলী (আ) তাকে বলছিলো: হে যুবক! জেগে ওঠো! ভালো করে কোমর বাঁধো।
এতোক্ষণ পর্যন্ত মালেকের গোংরানোরও শক্তি ছিল না। অথচ স্বপ্ন দেখার পর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো দাঁড়িয়ে গেল সে। স্বপ্নের ভেতরেই একরাশ বিস্ময় চোখে মেখে হযরতের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। হযরত আলি (আ) তাকে বললো: এর পর থেকে যখনই কোনো সমস্যায় পড়বে তখনই বলবে: ‘ইয়া আলি’! তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ বলেই আলি (আ) অদৃশ্য হয়ে গেল।
মালেক মুহাম্মাদের ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখলো তার শরীরে কোনোরকম ব্যথা-বেদনা নেই। পুরোপুরি সুস্থ সে। এদিক সেদিক তাকালো। দেখলো তার ঘোড়া এবং জিন সব কিছুই ঠিক আছে। প্রশান্ত মনে দৃঢ় বিশ্বাস বুকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়লো এবং সতেজভাবে ঘোড়া ছুটালো।#
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (২)
২৮ জানুয়ারি(রেডিও তেহরান): হযরত আলি (আ) স্বপ্নের ভেতর মালেক মুহাম্মদকে বলেছিল: এর পর থেকে যখনই কোনো সমস্যায় পড়বে তখনই বলবে: ‘ইয়া আলি’! তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ বলেই আলি (আ) অদৃশ্য হয়ে গেল। মালিক মুহাম্মদের ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখলো তার শরীরে কোনোরকম ব্যথা-বেদনা নেই। পুরোপুরি সুস্থ সে।
এদিক সেদিক তাকালো। দেখলো তার ঘোড়া এবং জিন সব কিছুই ঠিক আছে। প্রশান্ত মনে দৃঢ় বিশ্বাস বুকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়লো এবং সতেজভাবে ঘোড়া ছুটালো।
এদিকে তার ছয় ভাই যারা তাকে মেরেছিল তারা যেতে যেতে এক শহরে গিয়ে পৌঁছলো। ওই শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে তারা ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে তারা গিয়ে পড়লো এক জুয়ার গলিতে। ওই গলিতে জুয়া খেলা হয় বলে এরকম নাম। এমনিতেই তারা জুয়া খেলতে পছন্দ করতো। মালেককে মারার পর মাথার ভেতর যে দুশ্চিন্তা কাজ করছিল সেই দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য তারা জুয়ার আড্ডায় বসতে চাইলো। সবাই মিলে তাই করলো। জুয়া খেলার আস্তানায় ঢুকে পড়লো তারা এবং শুরু করে দিলো জুয়া খেলা। খেলতে খেলতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল তারা। যা কিছুই ছিল সব হারিয়ে বসলো। এমনকি রাতের খরচটুকুও অবশিষ্ট রইলো না। পকেট শূন্য হয়ে যাবার পর উপায়ন্তর না দেখে তাদের তিন জন গেল ভিক্ষা করতে। বাকি তিনজনের একজন গেল নেহারির দোকানে কাজ করতে, আরেকজন গেল গোসলখানার কাজে আর তৃতীয়জন গেল রান্নার কাজে সহযোগিতা করতে।
অপরদিকে মালিক মুহাম্মাদ যেতে যেতে সামনে দেখলো একটা শহর। ওই শহরেই উঠলো সে। ঘটনাক্রমে তার যে তিনভাই ভিক্ষা করার জন্য এক শহরে গিয়েছিল এটা ছিল সেই শহর। তখন ছিল রাত। মালিক কিছুই চিনে উঠতে পারছিল না। সকালের অপেক্ষায় রাতটা সেখানেই কাটাতে চাইলো। কিন্তু কোথায় থাকবে! ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত এক বুড়ির বাসার দরোজায় আঘাত করলো। বুড়ি ঘরের দরোজা খুলতেই মালিক বললো: ‘হে মা আমার! আমি একজন মুসাফির। অপরিচিত এই শহরে থাকার কোনো জায়গা পাচ্ছি না। অনুমতি দিলে আমি আপনার ঘরে রাতটা কাটিয়ে সকাল হলেই আমার কাজে বেরিয়ে যাবো’।
বুড়ি খুব ভালো করে মালেককে দেখলো। বুড়ির মনে হলো মালিক যে সে কোনো লোক নয়, ওকে বাদশাহ কিংবা রাজপুত্রের মতো লাগে। বুড়ি মালেককে বললো: ‘হে যুবক! তোমার যদি রুচিতে না বাধে, যদি গরিবের প্রতি তোমার সুদৃষ্টি থেকে থাকে তাহলে সুস্বাগত তোমাকে’!
মালিক ঘরে ঢুকলো। বুড়ি তার এক মেয়েকে নিয়ে ওই ঘরে বাস করতো। ঘরে ঢুকেই মালিক চারদিকে তাকিয়ে দেখলো বর্ণনা করার মতো তেমন কিছুই নেই। খোরজিন থেকে একটা মুক্তা বের করে বুড়ির হাতে দিয়ে বললো: ‘এটা বিক্রি করে রাতের জন্য খাবার দাবারের ব্যবস্থা করুন’।
মালেকের দেওয়া মুক্তাটি বিক্রি করে বুড়ি ওই রাতের খাবারের আয়োজন করলো। খাওয়া শেষে মালিক লক্ষ্য করলো বুড়ি কাঁদছে।
মালিক বললো: মা! কাঁদছো কেন?
বুড়ি বললো: রাজকন্যার কথা ভেবে কাঁদছি। ওর জন্য আমার মনটা কাঁদে।
মালিক বললো: কেন কী হয়েছে রাজকন্যার!
বুড়ি বললো: সম্প্রতি একটা দৈত্য কোত্থেকে যেন আসে। প্রতি মাসে একবার আসে। এসে একটা মেয়ে, চুয়ান্ন কিলো ওজনের এক ঝুড়ি খুরমা এবং ত্রিশ কিলো হালুয়া প্রত্যেকের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে নিচ্ছে। সবার কাছ থেকেই নেয়া হয়েছে,আজ বাদশার দেওয়ার পালা। সে কারণেই বাদশার মেয়ের জন্য মনটা পুড়ছে। আমি ওর ধাইমা হই কিনা।
এসব শুনে মালিক মুহাম্মদ হযরত আলি (আ) এর কথা স্মরণ করলো। তলোয়ার কোমরে বাঁধলো। বুড়ি যখন দেখলো মালিক মুহাম্মদ যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে,বললো: হে প্রিয় সন্তান আমার! কী করতে চাচ্ছো তুমি?
মালিক বললো: ভাবছি যাবো, দৈত্যের অত্যাচার থেকে জনগণকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করবো।
বুড়ি বললো: হে যুবক! তোমার যৌবনের কসম,রহম করো! বাদশা এ পর্যন্ত কয়েক দল সৈন্য পাঠিয়েছে ওই দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য, কিন্তু কেউই জিততে পারেনি, মারাত্মকভাবে পরাজিত হয়েছে। এখন তুমিও যদি যাও,নির্ঘাত মারা যাবে।
মালিক বললো: হে বুড়ো মা! আমার রক্ত ওই রাজকন্যার রক্তের চেয়ে বেশি রঙিন নয়। আল্লাহ চাহে তো আমি যাবো। তুমি শুধু আমাকে ওই দৈত্যটার জায়গা দেখিয়ে দাও!
বুড়ি যখন দেখলো মালিক একেবারেই নাছোড়বান্দা, যাবেই সে, অগত্যা বললো: দরোজা দিয়ে বাইরে গেলে একটা গম্বুজ দেখতে পাবে। ওই গম্বুজের নীচে দেখবে রাজকন্যা বসে আছে খুরমার ঝুড়ি আর হালুয়া নিয়ে।
মালিক মুহাম্মদ বাসার বাইরে এসে আবারও হযরত আলী (আ) কে স্মরণ করলো। এরপর ঘোড়ার পিঠে চড়ে দরোজার বাইরে গিয়ে দেখলো সত্যিই একটা গম্বুজ দেখা যাচ্ছে। গম্বুজের দিকে গেল। রাজকন্যা দেখলো মালিক তার দিকে আসছে। কাছাকাছি যেতেই মালিক রাজকন্যাকে বললো: এই বাদশার মেয়ে! এই গম্বুজের কাছে বসে বসে কী করছো তুমি!
রাজকন্যা মালিকের দিকে তাকিয়ে ভাবলো লোকটাকে তো মন্দ বলে মনে হচ্ছে না।
মালিক মুহাম্মদ আবারো বললো: এই রাজকন্যা! আমি এসেছি তোমাকে মুক্ত করতে।
একথা শুনে রাজকন্যা অঝোরে কাঁদতে শুরু করে দিলো।#
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৩)
২ ফেব্রুয়ারি (রেডিও তেহরান): বলছিলাম বাদশা তার মেয়ের দু:খে ঘুমাতে পারছিল না। মুয়াজ্জিনের ভুল আজানের ধ্বনি তার কানে যেতেই মুয়াজ্জিনকে ডেকে পাঠালো। বাদশার পাইক পেয়াদারা যথারীতি মুয়াজ্জিনকে ধরে নিয়ে এলো। বাদশাহ মুয়াজ্জিনের ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলো: কী হয়েছে?
মুয়াজ্জিন বললো: হে বাদশা নামদার! জানি না কী হয়ে গেল! মনে হচ্ছে দৈত্যের ক্ষুধা মেটে নি। ও গম্বুজের কাছে ঘুমিয়ে আছে। আমার মনে হয় ও এই শহরেই থেকে যেতে চাচ্ছে।
মুয়াজ্জিনের কথা শুনে বাদশাহ এক বুড়োকে ডেকে পাঠালো এবং তাকে প্রচুর টাকা পয়সা দিয়ে গম্বুজের খোজ খবর নিয়ে আসতে বললো। বুড়ো লোকটার তো করার কিছুই নেই। কাঁপতে কাঁপতে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে টাকাগুলো গ্রহণ করলো এবং ভয়ে ভয়ে পা বাড়ালো গম্বুজের দিকে।
আস্তে আস্তে পা ফেলে চোখ কান খোলা রেখে সতর্কতার সাথে গেল গম্বুজের কাছে। গম্বুজের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে রাতের আঁধার কেটে গিয়ে সকাল হয়ে গেল। চারদিক ফর্সা হয়ে গেল তখন। বুড়ো তখন দেখলো দৈত্যটা গম্বুজের কাছে ঘুমায় নি বরং মাটিতে পড়ে ছিল দৈত্যের কাটা পা। বুড়োর মনে হলো সে বুঝি স্বপ্ন দেখছে। চোখ কচলাতে কচলাতে গম্বুজের আরও কাছে গেল। কাছে গিয়ে দেখলো: নাতো, সে স্বপ্ন দেখছে না, সত্যই দেখছে,বাস্তবই দেখছে। কৌতূহলী হয়ে উঠলো বৃদ্ধ। পা টিপে টিপে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় কাঁপতে কাঁপতে উপরের দিকে গেল এবং গম্বুজের ভেতরে ঢুকলো।
ভেতরে ঢুকে তো বৃদ্ধের চোখ ছানাবড়া। সে দেখলো বাদশার সুন্দরী কন্যা আর এক সুদর্শন যুবক গম্বুজের ভেতর ফ্লোরে শুয়ে আছে। বুড়ো বুঝতে পারছিল না সে কি সত্যি দেখছে নাকি স্বপ্ন। সে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো সত্যিই তারা মানুষ এবং বেঁচে আছে। খুশিতে আটখানা হয়ে গেল বৃদ্ধ। দেরি না করে দ্রুত ছুটে গেল বাদশার কাছে। বাদশাকে বললো: ‘হে বাদশা! গম্বুজের দরোজায় তো দৈত্য ঘুমোয় নি। বরং দৈত্যের একটা কাটা পা সেখানে পড়ে আছে। বিশাল ওই পা পুরো জায়গা জুড়ে নিয়েছে। আর তোমার কন্যা গম্বুজের ভেতরে নিরাপদে আছে, বেঁচে আছে। এক সুদর্শন যুবকও আছে ভেতরে তোমার কন্যার সাথে’। একথা শোনার পর বাদশার কী প্রতিক্রিয়া হলো তা শুনবো খানিক বিরতির পর। আপনারাও ভাবুন।
কী বন্ধুরা! ভেবেছেন তো! দেখুন আপনাদের চিন্তার সঙ্গে মেলে কিনা। বাদশা তার কন্যার বেঁচে থাকার সংবাদ শুনেই খুশিতে নেচে উঠলো। কী যে করবে আর বলবে ভেবে কুল পাচ্ছিল না। আনন্দের সাথে বলে উঠলো: ‘এ কাজ নিশ্চয়ই ওই যুবকের। হ্যাঁ,নিশ্চয়ই ওই যুবকের। আমি চাচ্ছি তোমরা কেউ গম্বুজের ভেতর যাও এবং তারা দুজন যেভাবে শুয়ে আছে ঠিক সেভাবে রেখেই অর্থাৎ সে অবস্থাতেই তাদেরকে নিয়ে এসে আমার পালঙ্কের পাশে তাদের রেখে দাও’!
এদিকে ঘটলো আরেক ঘটনা। বাদশার এক মন্ত্রীর ছেলে ছিল। সে বাদশার মেয়েকে ভালবাসতো। ওই মন্ত্রী যখন শুনতে পেলো বাদশার মেয়ে মরে নি বরং বেঁচে আছে, তখন মনে মনে বললো:যাক বাবা! শেষ পর্যন্ত আমার ছেলের ইচ্ছে তাহলে পূর্ণ হতে যাচ্ছে, সে রাজকন্যাকে পেতে যাচ্ছে। এই ভেবেচিন্তে মন্ত্রী বাদশার দিকে তাকিয়ে বললো: “বাদশা মহাশয়! ওদেরকে ঘুমন্ত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসার কী দরকার! অপেক্ষা করুন! ভোর তো মাত্র হলো! সূর্য ভালো করে উঠুক।ওদের ঘুমও ভাঙুক। তারপর না হয় কাউকে পাঠিয়ে তাদেরকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবো এবং ওই ছেলেকে অভিযুক্ত করে তার গর্দান নেওয়ার ব্যবস্থা করবো। আর আমার ছেলের সঙ্গে আপনার কন্যার বিয়ের আয়োজন করবো”।
বাদশাহ তার মন্ত্রীর কথা শুনে ভীষণ বিরক্ত হলো। বললো: ‘জল্লাদ! মন্ত্রীর জিহ্বা কেটে ফেল’!
জল্লাদের তো কাজই হলো বাদশার আদেশ পালন করা। সে দাঁড়িয়েই ছিল আদেশের অপেক্ষায়। যখন যে আদেশ পাবে তাই করবে। সে মন্ত্রীর জিহ্বা কেটে ফেলল।
এরপর বাদশাহ আদেশ দিলো তাড়াতাড়ি গিয়ে তার কন্যা আর ওই যুবকটাকে নিয়ে আসতে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন চলে গেল এবং তাদের দুজনকে নিয়ে হাজির হয়ে গেল প্রাসাদে। প্রাসাদে বাদশার পালঙ্কের পাশেই তাদের ঘুমোনোর ব্যবস্থা করলো। কিছুই টের পেল না তারা। কিছুক্ষণ পর মালেক মুহাম্মাদের ঘুম ভেঙে গেল। সে ঘুম থেকে জেগেই দেখলো বাদশার প্রাসাদে তারই পালঙ্কের পাশে সে।
তার বিস্ময় ভাঙিয়ে দিয়ে বাদশাহ বললো: ‘এই যুবক! তুমি যে-ই হও না কেন আমার জানার দরকার নেই। তুমি আমার মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছো এবং আমাকে ও এই মুলুকের জনগণকে ওই দৈত্যের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছো’! বাদশাহ এটুকু বলতেই তার মেয়েও জেগে উঠলো ঘুম থেকে। রাতে দৈত্যের সাথে ওই গম্বুজে যা যা ঘটেছিল সব খুলে বললো পিতাকে। বাদশাহ যুবকের বীরত্ব ও সাহসিকতার কথা শুনে বললো: ‘হে যুবক! তুমি এবার আমার কন্যাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে কবুল করো! আমি তোমার সাথে ওর বিয়ের আয়োজন করবো এবং তোমার হাতে তার হাত সঁপে দেবো’।
মালেক মুহাম্মাদ রাজি হলো এবং বাদশা আদেশ দিলো পুরো শহরকে যেন ঝলমলে করে সাজানো হয়। সাতরাত সাতদিন উৎসব হলো। সপ্তম রাতে আকদ অনুষ্ঠান হলো। রাতে মালেক মুহাম্মাদ স্ত্রীকে বললো: ‘আমার অনেক কাজ পড়ে আছে,যেতে হবে। পথ খুবই বিপদ সংকুল।যদি ফিরে আসি তাহলে তুমি তো আমার স্ত্রীই থাকবে। আর যদি ফিরে না আসি তবে তুমি আবার বিয়ে করে নিও’! রাজকন্যা মালেক মুহাম্মাদকে ‘বীর’ বলে প্রশংসা করলো।
সকালবেলা মালেক মুহাম্মাদ গেল বাদশাহর দরবারে। বললো: হে বাদশাহ! আমি আজ পার্শ্ববর্তী শহরের উজিরের কাছে যেতে চাই। ওই শহরটা দেখতে চাই!
বাদশাহ আদেশ দিলো মন্ত্রীর শহরকে যেন সাজানো হয়। তারপর মালেক মুহাম্মাদ দরবারের কতিপয় অভিজাত ব্যক্তিকে নিয়ে মন্ত্রীর শহরের দিকে রওনা দেয়।#
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৪)
মালেক মুহাম্মাদ যখন বললো ‘হে রাজকন্যা! আমি এসেছি তোমাকে দৈত্যের হাত থেকে বাঁচাতে’। অমনি রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে মালেককে বললো: ‘হে যুবক! তুমি তোমার নিজের জীবনের জন্য একটু ভাবো। এই দৈত্য ভয়ংকর। তোমাকে দেখামাত্রই তোমার ওপর হামলা করবে এবং তোমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে। তোমার মাথা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলবে। তুমি তোমার ওই যৌবনের প্রতি সদয় হও, নিজের প্রাণ রক্ষা করো!’
মালেক বললো: যার মওলা হচ্ছে হযরত আলি (আ),দৈত্য-দানবে তার আর ভয় কী! আমি কোনো পরোয়া করি না। আল্লাহর ইচ্ছায় এবং মওলা আলির সাহায্যে এসেছি তোমাকে ওই দৈত্যের হাত থেকে রক্ষা করতে। তুমি বেঁচে গেলে তোমার পিতা মাতাও খুশি হবে,আনন্দিত হবে।
রাজকন্যা মালেক মুহাম্মাদের কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলো এবং কান্নাকাটি বন্ধ করে প্রশান্ত হলো কিছুটা। একটু পরে সে মালেক মুহাম্মাদকে বললো: ‘ঠিক আছে! তুমি যা ভালো মনে কর,করো’!
রাজকন্যার কথা আর সম্মতি পেয়ে মালেক মুহাম্মাদ তার পাশে গিয়ে বসলো। মালেককে পাশে পেয়ে রাজকন্যার একটু সাহস হলো। অন্তত মুখ ফুটে কারও সাথে কথা বলার মতো অবস্থা হলো তার। বললো: ‘হে যুবক! তুমি তো দেখছি আত্মহত্যা করতে চাচ্ছো। শোনো! এই দৈত্য আসার তিনটা লক্ষণ আছে। সে যখন ভূমি থেকে আকাশে উড়তে যায় বাতাস তখন একটু গরম হয়ে ওঠে। যখন সে উড়তে থাকে আবহাওয়া তখন ভীষণ গরম হয়ে যায়। এমন গরম যে মনে হয় গা পুড়ে যাবে। তৃতীয় লক্ষণ হলো যখন সে কাছাকাছি চলে আসে বিশ্রি গন্ধে চারদিকের পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে। ওই গন্ধে জনগণের বেঁচে থাকা দায় হয়ে যায়।
রাজকন্যার কথা শুনে মালেক মুহাম্মাদ বললো: হে রাজকন্যা! আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। যদি ঘুম এসেই যায় তাহলে ওই প্রথম আলামত পেয়েই তুমি আমাকে জাগিয়ে তুলবে।
রাজকন্যা বললো: ঠিক আছে।
কিন্তু মালেক ঘুমাতে না ঘুমাতেই প্রথম নিদর্শনটা উপলব্ধি করলো রাজকন্যা। সে মালেক মুহাম্মাদের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকালো। কী গভীর ঘুমে সে। কী করে তাকে এই চমৎকার ঘুম থেকে উঠাবে সে,বুঝে উঠতে পারছিল না। বিস্ময় বিহ্বল হয়ে পড়ে রইলো রাজকন্যা। এমন সময় দ্বিতীয় লক্ষণও দেখা দিলো। এবারও রাজকন্যার মন চাইলো না কাঁচা ঘুম থেকে মালেক মুহাম্মাদকে জাগাতে। কিন্তু একটু পরেই বিশ্রি গন্ধটা নাকে আসতে লাগলো। বোঝা যাচ্ছিলো দৈত্যটা কাছাকাছি এসে গেছে। শ্রোতাবন্ধুরা! গন্ধটা নাক থেকে সরানোর জন্য একটু বিরতিতে যাচ্ছি।
কী আশ্চর্য! গন্ধ তো গেলোই না বরং আরও বেড়ে গেল। অথচ রাজকন্যা মালেক মুহাম্মাদকে এবারও ঘুম থেকে জাগাতে চাইলো না। এদিকে ভয়ে কষ্টে তার চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে শুরু করলো। ওই অশ্রুরই একটা ফোঁটা পড়লো ঘুমন্ত মালেকের চোখেমুখে। পড়তেই মালেকের ঘুম ভেঙে গেল এবং এক লাফে সে উঠে দাঁড়ালো। রাজকন্যাকে কাঁদতে দেখে সে জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে কাঁদছো কেন?
রাজকন্যা বললো: হে যুবক! দৈত্যের আসার সকল আলামত ফুটে উঠেছে। কিন্তু তুমি যেভাবে ঘুমুচ্ছিলে আমার মন চাচ্ছিল না তোমাকে জাগাই। এক্ষুণি কিন্তু দৈত্য এসে পড়বে।
মালেক মুহাম্মাদ দ্রুত তার গেলাফ থেকে তলোয়ারটা বের করে দাঁড়ালো। রাজকন্যা তলোয়ার দেখে ভয় পেয়ে এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
মালেক মুহাম্মাদ আলী (আ) কে স্মরণ করলো। দৈত্যের চীৎকার তার কানে ভেসে এলো। বিশ্রি গন্ধে পরিবেশ দূষিত হয়ে গেল। যেন মরে যাবার উপক্রম। দৈত্য এরিমাঝে এসে পড়লো। এসেই তার নজর পড়লো মালেক মুহাম্মাদের ওপর। দৈত্য বিশ্রি এক হাসি দিয়ে বললো: মানুষের জাত নাকি ভয় পায় যে সে কাজে হাত দিতে। কিন্তু এখন দেখছি রাজকন্যার পালা যখন এলো একটা যুবক আর একটা ঘোড়াও বোনাস হিসেবে এসেছে আমার জন্য হা হা হা....।
মালেক মুহাম্মাদ চীৎকার করে বললো: মুখ বন্ধ কর তুই! আমি এসেছি তোকে হত্যা করার জন্য। আল্লাহর ইচ্ছায় আমিই হবো তোর হত্যাকারী।
দৈত্য মালেকের কথা শুনে বিরক্ত হলো। তার হাতের গদা ছুঁড়ে মারলো মালেকের মাথা লক্ষ্য করে। মালেক মাথা সরিয়ে নিয়ে নিজেকে রক্ষা করলো। এরপর দৈত্যকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো। দৈত্যও সরে গিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলো কিন্তু পারলো না, তার উরুতে তলোয়ার গিয়ে আঘাত করলো। ধারালো তলোয়ারের আঘাতে দৈত্যের এক পা কেটে পড়ে গেল মাটিতে। দৈত্য মালেক মুহাম্মাদের বীরত্ব দেখে ভয় পেয়ে গেল এবং এক খণ্ড মেঘ হয়ে হাওয়ায় মিশে গেল।
রাজকন্যা আর মালেক মুহাম্মাদ একে অপরের দিকে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে তাকাতে লাগলো। দৈত্যের গায়ের গন্ধ মিলে গেলে দুজনেই আল্লাহর শোকর আদায় করলো।
সকালবেলা মুয়াজ্জিন যখন মসজিদের ছাদে উঠে আজান দিতে গেল সামনের গম্বুজের নীচের দিকে তাকাতেই তার সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। বিশাল কী যেন একটা তার নজরে পড়লো। ময়লার ওপর পড়ে আছে ওই বস্তুটা। ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো মুয়াজ্জিন। কাঁপতে কাঁপতে আজান দিতে গিয়ে গোলমাল করে ফেললো সে। মুয়াজ্জিনের ভুল আজানের ধ্বনি কানে গেল বাদশার।#
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৫)
জামাই শহর দেখতে যাবে তাই বাদশাহ আদেশ দিলো সংশ্লিষ্ট শহরকে যেন সাজানো হয়। তারপর মালেক মুহাম্মাদ দরবারের কতিপয় অভিজাত ব্যক্তিকে নিয়ে মন্ত্রীর শহরের দিকে রওনা দেয়। মালেক মুহাম্মাদের ছয় ভাইয়ের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের।
তারা এই শহরেই কেউ ভিক্ষা করে খায়, কেউবা টুকটাক চাকর বাকরের কাজ করে। তারা যখন শুনলো যে বাদশার মেয়ের জামাই যাবে ওই শহর দেখতে,তারা প্রস্তুত হলো শহরে যেতে এবং রাজকন্যার জামাইকে দেখতে। তাদের যে তিন ভাই ভিক্ষা করতো তারা বললো যে এই শহরের তো তিনটা প্রবেশদ্বার রয়েছে। সুতরাং তিন দ্বারে তিনজন যাবো এবং হুক্কা সাজাবো জামাইর জন্য। বাদশার জামাই যদি খুশি হয় তাহলে নিশ্চয়ই কিছু দেবে।
যেই কথা সেই কাজ। তিন ভাই লেগে গেল হুক্কা সাজানোর কাজে। হুক্কা সাজিয়ে পরিকল্পনামতো বিভিন্ন গেইটে তারা দাঁড়ালো। মালেক মুহাম্মাদ প্রথম প্রবেশদ্বারে যেতেই হুক্কা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে দেখতে পেল। ওই যুবক মালেকের কাছাকাছি যেতেই মালেক তাকে চিনতে পারলো। যুবক মালেকের হাতে হুক্কাটা দিলো। দু’এক টান দিয়ে মালেক হুক্কাটা যুবকের হাতে ফেরত দিয়ে সামনে অগ্রসর হলো। বাকি দুই গেইটেও অন্য দু’ভাইকে হুক্কা হাতে পেল এবং এক-দুই টান দিয়ে তাদেরকেও হুক্কা ফেরত দিয়ে অগ্রসর হয়ে গেল নিজের পথে। এই দুই ভাইও মালেক মুহাম্মাদকে চিনতে পারলো না।
এদিকে মালেক মুহাম্মাদ গিয়ে পৌঁছলো উৎসব অনুষ্ঠানে। সেখানে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে তার জন্য সাজানো রাজকীয় আসনে বসলো। হঠাৎ দেখ পেল হাম্মামের রক্ষণাবেক্ষণকারী তার চাকরকে বলছে: বাদশার জামাই হাম্মামে আনছে। তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস! কোনো কাজ করছিস না! যা,হাম্মামের উষ্ণতা আরও বাড়িয়ে দে। মালেক মুহাম্মাদের দৃষ্টি পড়লো ওই চাকরের ওপর। দেখেই চিনতে পারলো এ-ও তার আরেক ভাই। অপরপ্রান্তেও তাকিয়ে দেখলো বাবুর্চি তার চাকরকে বলছে: দুপুর হয়ে গেছে, এখন বাদশার জামাই খাবার খেতে আসবে। অথচ তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস!
হাতের ওপর হাত রেখে আরাম করছিস! মালেক মুহাম্মাদের দৃষ্টি গেল সেদিকে। দেখলো ওই চাকরও তার আরেক ভাই। মালেক মুহাম্মাদ ঘাড় ফেরালো অন্যদিকে। দেখলো ঠিক সেই মুহূর্তেই নেহারির বাবুর্চি তার চাকরকে বলছে: কাল সকালে বাদশার জামাই আমার কাছ থেকে নেহারি খেতে চাইবে। অথচ তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিস! মালেকের দৃষ্টি গেল ওই চাকরের দিকে। দেখলো এই চাকরও তারই আরেক ভাই।
মালেক মুহাম্মাদ তার সকল ভাইকেই ঠিকঠাকমতো চিনতে পারলো। কিন্তু ভাইয়েরা তাকে চিনতে পারলো না। মালেক মুহাম্মাদের আর সহ্য হচ্ছিল না। তার সঙ্গে আসা বাহিনীকে আদেশ দিলো মন্ত্রীর শহরে যেন হামলা চালায়। কিন্তু জিহ্বাকাটা মন্ত্রী আদেশ শুনে মালেক মুহাম্মাদের হাত পা জড়িয়ে ধরলো। অনুনয় বিনয় করে বোঝালো সে যেন তার সেনাদেরকে ফেরায়। মালেক মুহাম্মাদ বললো: এক শর্তে আমি তাদের থামাতে পারি। শর্তটা হলো এক্ষুণি তোমার বাবুর্চি, হাম্মামের ওস্তাদ এবং নেহারি প্রস্তুতকারী ওস্তাদকে আমার সামনে হাজির করবে।
জিহ্বাকাটা মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাদের তিনজনকেই ডেকে পাঠালো। তিনজনই যখন জামাইর সামনে এলো জামাই আদেশ দিলো তিনজনকেই যেন হালকা চড় দেওয়া হয়। তাই করা হলো এবং বুঝিয়ে দিলো তারা যেন আর কখনো তাদের চাকরদের চড়-থাপ্পড় না মারে।
মালেক মুহাম্মাদ ভাইদের সবাইকে চিনতে পেরে মনে মনে বললো: এরা তো সবাই জুয়াড়ি। সম্ভবত জুয়া খেলে ভাইয়েরা তাদের সব টাকা পয়সা হারিয়ে বসেছে। সে কারণেই তাদের আজ এই দশা। এই ভেবেচিন্তে মালেক আদেশ দিলো সকল জুয়াড়িকে যেন তার সামনে হাজির করা হয়। সবাইকে হাজির করা হলে মুহাম্মাদ তাদের থাপ্পড় মেরে তিরষ্কার করে। তারপর জুয়াড়িদেরকে তার ভাইদের দেখিয়ে বলে: এদের কাছ থেকে যত টাকা তোরা জুয়া খেলে নিয়েছিস,সব টাকা ফেরত দে! জুয়াড়িরা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে দিলো এবং অচেনাদের কাছ থেকে যা কিছু নিয়েছিল সব ফেরত দিলো।
মালেক মুহাম্মাদ এবার আদেশ দিলো: তিন প্রবেশদ্বারে যে তিনজন হুক্কা সাজিয়ে তাকে দিয়েছিল তাদেরকে যেন হাজির করা হয়। আদেশ দেয়ামাত্র তাদের হাজির করা হলো। মালেক মুহাম্মাদ ছয় ভাইকে নিয়ে আড়ালে গেল। এরপর ছয় ভাইকে বললো: “খুব ভালো করে আমার দিকে তাকাও!...আমি তোমাদেরই ভাই”। সবাই তাকালো এবং মালেক মুহাম্মাদকে চিনতে পারলো। লজ্জায় ছয় ভাই তাদের মাথা নীচু করে রাখলো। মালেক মুহাম্মাদ হেসে দিয়ে বললো: যা হবার তো হয়েই গেছে! এখন আর লজ্জা পেয়ে কাজ নেই। সবাই আমার সঙ্গে চলো রাজপ্রাসাদে। তাদেরকে রাজকীয় পোশাক পরানো হলো। ওই পোশাক পরেই তারা প্রাসাদে ঢুকলো।
মালেক মুহাম্মাদ বাদশার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো: হে বাদশাহ! আমার ভাইয়েরা আমাদের দেশ থেকে এসেছে। আমাকে তাদের সাথে যেতে হবে এবং সোনার খাঁচা আর ময়না পাখি নিয়ে আসতে হবে। বাদশাহ মালেক মুহাম্মাদকে সফরে যাবার অনুমতি দিলো এবং সকল প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হলো ঘোড়ায় চড়ে।
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৬)
মালেক মুহাম্মাদ যেতে যেতে গিয়ে পৌঁছলো একটি শহরের কাছে। ওই শহরের বাদশাহ কী কাজে যেন প্রাসাদের ছাদের ওপরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাদশা দেখতে পাচ্ছিল দূর থেকে সাতজন ঘোড় সওয়ার শহরের দিকে আসছে।
বাদশাহ মনে মনে বলছিল: ‘দেখেশুনে মনে হচ্ছে যুবকেরা অভিজাত এবং সম্ভ্রান্তই হবে। ভালোই হলো,আমার সাত কন্যাকে ওই সাত যুবকের হাতে সঁপে দেব’। এই ভেবে বাদশাহ ওই যুবকদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কয়েকজন কর্মকর্তা পাঠিয়ে দিলেন। তারা যখন শহরে প্রবেশ করলো সোজা নিয়ে আসা হলো প্রাসাদে।
বাদশাহ যখন জানতে পেল সাত ভাই-ই শাহজাদা,ভীষণ খুশি হলো এবং ভালোমতো তাদের আদর আপ্যায়ন করলো। অবশেষে বললো: শাহজাদাগণ! আমার সাতটি মেয়ে আছে। তোমাদের সাতজনের সাথে তাদের আক্‌দ করতে চাই। মালেক মুহাম্মাদ এবং তার ভাইয়েরা বাদশার প্রস্তাব গ্রহণ করলো। বাদশার আদেশে পুরো শহরকে জাঁকজমকপূর্ণ করে সাজানো হলো। সাত দিন সাত রাত্রি ধরে শহরের লোকজন উৎসবের আমেজে মেতে রইলো এবং সপ্তম রাতে ঘটা করে আকদ অনুষ্ঠান পালন করা হলো। বাদশার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি হলো মালেক মুহাম্মাদের স্ত্রী। মালেক মুহাম্মাদ তাকে বললো: একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাকে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। সংসার ধর্ম পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যে সফরে যাচ্ছি সেটা খুবই ভয়ংকর পথ। যদি ফিরে আসি তো ভালো আর যদি না আসি তাহলে তুমি আবার বিয়ে করে নিও।
মালেকের ভাইয়েরা বেশ কটা দিন তাদের স্ত্রীদের নিয়ে ভালোভাবেই কাটালো। তারপর বাদশার অনুমতি নিয়ে আপনাপন স্ত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সফরে বের হয়ে গেল। দিন রাত তারা ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে লাগলো। চতুর্থ দিন দুপুরের খানিক আগে তারা গিয়ে পৌঁছলো একটা দূর্গের কাছে। মালেক মুহাম্মাদ দূর্গের উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে নোঙর নিক্ষেপ করে উঠে হযরত আলিকে স্মরণ করলো এবং দেয়াল টপকে কেল্লায় ঢুকে পড়লো। দরোজা খুলে দিলে ভাইয়েরাও ভেতরে ঢুকলো। কেল্লার ভেতর সাতটি কক্ষে সাতটি ভাতের পাতিল রাখা ছিল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল না। মালেক মুহাম্মাদ ভাইদের বললো: আল্লাহর ওপর ভরসা করে চলো একেকজন একেক রুমে যাই। সবাই তাই করলো। কিন্তু দুপুর হতে না হতেই ঘটলো আশ্চর্য এক ঘটনা।
মালেক মুহাম্মাদ ভাইদের নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিল। ওই উৎকণ্ঠার ভেতরেই মালেক দেখলো তার রুমের দরোজা খুলে অসম্ভব সুন্দরী এক মেয়ে ঢুকছে। মেয়েটির মুখে ছিল হাসি। বেশ প্রাণবন্তই লাগছিল তাকে। রুমের এক কোণে গিয়ে বসে মেয়েটি হঠাৎ কেঁদে উঠলো। মালেক মুহাম্মাদ অবাক হয়ে ভাবলো: ওই প্রাণবন্ত হাসিই বা কেন আর এই কান্নাই বা কেন! সে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে গেল মেয়েটির কাছে। বললো: তুমি কাঁদছো কেন?
মেয়েটি বললো: হে শাহজাদা মালেক মুহাম্মাদ! আমরা সাত বোন! আমি সবার ছোট। আমরা পরী হবার কারণে সবকিছুর খবর জানি। সে কারণে আমরা সাতবোনই জানি তুমি ময়না পাখি আর সোনার খাঁচার সন্ধানে যাচ্ছো। তুমি জেনে রাখো যে আমি হলাম তোমার স্ত্রী। সে কারণে আমার অন্য ছয় বোন আমাকে নিয়ে হিংসা করছে এবং তোমার আগমনের অপেক্ষায় আছে, তোমাকে মারার জন্য।
পরী আরও বললো: এক কাজ করো! আমার বোনেরা এসে পৌঁছার আগেই তুমি এবং তোমার ছয় ভাই লুকিয়ে পড়। মালেক মুহাম্মাদ তাই করলো। তাড়াতাড়ি ভাইদের নিয়ে লুকিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ ওই ছয় পরী এসে নিজ নিজ রুমে ঢুকে বুঝতে পারলো এখানে কারও হাত পড়েছে। সবাই গিয়ে ছোট বোনকে জিজ্ঞেস করলো: ঘরে কেউ এসেছে নাকি! তুমি যেহেতু আগেভাগে এসেছো নিশ্চয়ই দেখেছো কে এসেছে। সত্যি করে বলো নৈলে কিন্তু মেরে ফেলবো। পরীদের ছোট্ট বোন বললো: আমি তাদেরকে দেখাতে পারি এক শর্তে। শর্তটা হলো তোমরা তাদের কোনো ক্ষতি করবে না। যদি কথা দাও তাহলে আমরা শিকারে না গিয়ে প্রতিদিন ওদেরকে পাঠাবো আর আমরা নিশ্চিন্তে আরামে বসবাস করতে পারবো।
বোনেরা মেনে নিলো। ছোট পরী এবার মালেক মুহাম্মাদসহ তার সব ভাইকে সামনে হাজির করলো। ছোট পরী বললো: আমি শিকারের বিনিময়ে তোমাদের জীবন ভিক্ষা নিয়েছি। তোমরা এক্ষুণি শিকারে যাও! বলার সঙ্গে সঙ্গে মালেক মুহাম্মাদ তার ভাইদের নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসলো। ছোট্ট পরী মালেকের কানে কানে বললো: প্রাণে বাঁচতে চাইলে তাড়াতাড়ি ভাগো! এদিক দিয়ে গেলে সামনে একটা নদী পড়বে। নদী পর্যন্ত যেতে পারলে আর ভয় নেই। আমার বোনেরা আর তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। এই বলে মাথা থেকে এক গোছা চুল ছিঁড়ে মালেকের হাতে দিয়ে বললো: কখনো যদি আমার কথা মনে পড়ে কিংবা যদি কোনো বিপদে পড়ো এই চুলের গোছার ওপর হাত রাখবে,আমি হাজির হয়ে যাবো।
সাত ভাই শিকারের অজুহাত দেখিয়ে পালালো নদীর দিকে। এদিকে সাত পরী বসে পড়লো খোশগল্পে। কিছুক্ষণ পর ছোট বোন দূরবীন নিয়ে ছাদে গিয়ে দেখলো কদ্দুর গেছে সাত ভাই। দেখলো নদীর কাছে যেতে এখনো বাকি আছে। ছাদ থেকে ফিরে এসে পরীদের বললো: সাত ভাই মিলে শিকারে ব্যস্ত। বোনেরা আবার মশগুল হয়ে পড়লো নিজেদের গল্পে। কিছু সময় পর বোনেরা আবারও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। এক বোন ছাদে যেতে চাইলে ছোট বোন তাড়াতাড়ি দূরবীন হাতে নিয়ে আগেআগে চলে গেল এবং দেখলো এখনো নদীর কাছে পৌঁছায় নি তারা। ফিরে এসে বললো: ওরা ফিরছে। বোনেরা আবারও মজে উঠলো গল্পে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই এবার বড় বোন নিজেই গেল ছাদে এবং দেখলো সাত ভাই নদীর দিকে যাচ্ছে। চীৎকার করে উঠলো সে এবং দ্রুত ঘোড়ায় চড়ে সাত ভাইয়ের পেছনে ছুটলো। ছোট বোনও বড় বোনের সাথে সাথে গেল।
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৭)
মালেক মুহাম্মাদের হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল ছোট পরীর কথা। আনমনে তাই পেছনে তাকালো। তাকাতেই তার চোখ তো ছানাবড়া। পরীদের সাত বোন তাদের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে একেবারে। মালেক ছয় সহোদর ভাইকে নদীর দিকে পাঠিয়ে নিজে তাদের পেছনে রয়ে গেল। ওই ছয় ভাই বলছিল: তুমি কেন পেছনে থাকছো? ওরা তো এসে গেল বলে...!
মালেক মুহাম্মাদ বলল: তোমরা যাও! আমি মারা গেলে তো সমস্যা নেই। কেননা আমি তো তোমাদের কেউ নই। কিন্তু তোমাদের ছয় ভাইয়ের কোনো একজনের ক্ষতি হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরকম সংশয় উৎকণ্ঠার মধ্যেই তারা গিয়ে পৌঁছে গেল নদীতে। কিন্তু মালেক মুহাম্মাদ নদীতে পা বাড়াতেই পরীদের বড় বোন তার ঘোড়ার লেজ টেনে ধরে ফেললো। এ অবস্থা দেখে ছোট পরীও তার হাতের তলোয়ার দিয়ে এক কোপে ঘোড়ার লেজ কেটে দিল।
ব্যাস্ ... মালেক মুহাম্মাদ নিশ্চিন্তে গিয়ে পৌঁছল নদীতে। পরীদের বড় বোন ছোট বোনকে বলল: তুই কী করলি এটা!
ছোট পরী বলল: আমি তো ওর মাথাটাকে দুই টুকরা করে ফেলতে চেয়েছি কিন্তু আল্লাহ বোধ হয় ওদেরকে আমাদের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছেন, নৈলে ঘোড়ার লেজে কেন লাগবে! যাকগে, এখন দুঃখ করে আর কী হবে!
পরীদের নদী পার হবার অনুমতি নেই। অগত্যা তারা ফিরে গেল আপনগৃহে। এদিকে নদী পেরিয়ে মালেক মুহাম্মাদ তার ভাইদের বলল: ভীষণ এক বিপদ থেকে বাঁচা গেল। যাক। তোমরা এখন যার যার পরিবারের কাছে ফিরে যাও! আমি যাচ্ছি সোনার খাঁচা আর ময়না পাখির সন্ধানে। যদি ভালোয় ভালোয় ফিরে আসি তাহলে একসাথে যাব। তাই হলো। ছয় ভাই ফিরে গেল শহরে আর মালেক মুহাম্মাদ গেল মরুপ্রান্তরের দিকে।
যেতে যেতে অনেকদূর পেরিয়ে যাবার পর মালেক দেখল এক দরবেশ তার দিকে আসছে। কাছে এসে ওই দরবেশ তাকে বলল: হে যুবক! এসো! আমরা একটা বিষয়ে চুক্তি করি।
মালেক বলল: কীসের চুক্তি!
দরবেশ বলল: তুমি তোমার তলোয়ার আর ঘোড়াটা আমার কাছে দেবে আর আমি আমার এই পাত্র, দস্তরখান আর লম্বা লাঠিটা তোমাকে দেব।
মালেক বলল: এগুলোর বৈশিষ্ট্য কী?
দরবেশ বলল: পাত্রটা হাতে নিয়ে যত মেহমানই তোমার আসে শুধু ভেতরে হাত রেখে বলবে: হে সোলায়মান নবী! আমার মেহমান আছে। এরপর পাত্র থেকে যতই খাবার নেবে কমবে না। দস্তরখানের বৈশিষ্ট্য হলো এটা বিছিয়ে সোলায়মান নবীকে স্মরণ করে বলবে আমার মেহমান আছে। তারপর যতই রুটি নেবে শেষ হবে না। আর লাঠিটা হাতে নিয়ে বলবে: আমি অমুকের মাথাটা চাই। অমনি মাথাটা লাউয়ের মতো কাটা হয়ে যাবে।
পাঠক! আপনাদের কী মনে হয়, মালেক মুহাম্মাদ কি দরবেশের প্রস্তাবে রাজি হবে? হ্যাঁ! রাজি হয়ে গেছে সে এবং নিজের ঘোড়া আর তলোয়ার দরবেশ দিয়ে পাত্র, দস্তরখান আর লাঠিটা নিয়ে দিল। আর দরবেশ তলোয়ারটা কোমরে ঝুলিয়ে ঘোড়ায় চড়ে চলে গেল। মালেক মুহাম্মাদ দরবেশের দেয়া জিনিসগুলোকে একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাইলো। লাঠিটা হাতে নিয়ে বলল: হে সুলায়মান নবী! এই দরবেশের মাথাটা ফেলে দিতে চাই। বলতে না বলতেই দরবেশের মাথা কেটে গেল। মালেক ভেবেছিল দরবেশ হয়তো ওই তলোয়ার দিয়ে কাউকে অন্যায়ভাবে খুন করবে। সেজন্য পরীক্ষার শুরুতেই বেছে নিয়েছিল লাঠিটাকে।
মালেক মুহাম্মাদ এবার ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ারটা কোমরে ঝুলিয়ে ফিরে চললো পরীদের কেল্লার দিকে। ছোট পরী মালেককে দেখে বলল: তোমার কি জীবনের ভয় নেই। আমার বোনেরা তোমাকে দেখলে জীবিত রাখবে না। মালেক বলল: আল্লাহ মহান।
ছোট পরী বলল: যদি আমার বোনেরা না থাকতো তাহলে আমরা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারতাম। কোনোরকম টেনশন থাকতো না।
মালেক বলল: তুমি কিছু মনে না করলে বলি.. এদের হত্যা করা আমার কাছে পানি খাবার মতোই সহজ।
ছোট পরী রাজি হয়ে গেল এবং মালেক তার হাতের লাঠিটা তুলে বলল: হে সোলায়মান নবী! আমি চাই ওই ছয় বোনের মাথা লাউয়ের মতো কেটে ফেলতে।
এই বলে মালেক পরীকে বলল: যাও গিয়ে দেখো তোমার বোনদের কী অবস্থা!
পরী ভেতরে গিয়ে দেখলো ছয় বোনেরই মাথা কেটে পড়ে আছে। খুশিতে সে নাচতে নাচতে ফিরে এসে মালেককে বলল: হ্যা! বোনেরা মারা গেছে। এখন আমরা নিশ্চিন্তে জীবন যাপন করতে পারব।
মালেক মুহাম্মাদ বলল: কিন্তু আমার তো দূরের সফর আছে, চলে যেতে হবে।
পরী বলল: আমি জানি! তুমি সোনার খাঁচা আর ময়না পাখির সন্ধানে আছো। কিন্তু তুমি আমার সাহায্য ছাড়া এ কাজে যেতে পারবে না।
মালেক বলল: কেন?
পরী বলল: কারণ যেখানে এই খাঁচা আর ময়না রয়েছে সে স্থানটি এখান থেকে ৩৬০ কিলোমিটার দূরে। তার ১২০ কিলোমিটার জুড়ে চিতাবাঘের বাস। ১২০ কিলোমিটার জুড়ে বাঘ সিংহের বাস আর ১২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে দৈত্যদানবের বাস।
তুমি যেই সোনার খাঁচা আর ময়নার খোঁজ করছো সেই খাঁচা পরীদের বাদশার মেয়ের মাথার উপরে রাখা। শহর থেকে ওই মেয়ের প্রাসাদে যেতে সাতটি দরোজা আছে। প্রতিটি দরোজার পাহারায় রয়েছে দৈত্যরা। সপ্তম দরোজার প্রহরী সাত মাথার দৈত্য। কী করে তুমি এগুলো পেরুবে, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, মনোযোগ দিয়ে শোনো।#
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৮)
পরী মালেককে সেইসব বলে ঘুরে ঘুরে পায়চারী করতে লাগল এবং হঠাৎ করেই সে একটা বড় মুরগিতে পরিবর্তিত হয়ে গেল। মুরগি তার পাখা বিস্তার করে দিল এবং মালেক মুহাম্মাদ ওই বিস্তারিত পাখার ওপর চড়ে বসলো। মুরগি উড়াল দিল। ২৪০ কিলোমিটার আকাশপথ মানে চিতাবাঘ আর সিংহদের এলাকা পেরিয়ে গেল।
শেষের ভূখণ্ডটা যেহেতু দৈত্যদের ছিল সেজন্য পরী তার আসল রূপ ধারণ করল আর মালেক মুহাম্মাদকে একটা সুঁইয়ের রূপ দিয়ে তার গলার নীচে পুঁতে রাখল। এভাবে বাকি পথও পার হলো। এক সময় তারা গিয়ে পৌঁছলো শহরে এবং তারপর প্রথম দরোজায় গিয়ে উপস্থিত হলো। পরী এবার মালেক মুহাম্মাদকে তার আসলে রূপে পরিবর্তন করে দিল এবং সে নিজেও পরিণত হলো একটা কবুতরে। পরীদের বাদশার মেয়ের প্রাসাদের একটা খাঁজে গিয়ে বসে সে এবার দেখতে চাইলো দৈত্যগুলোর সাথে কী করে মালেক মুহাম্মাদ।
মালেক যখন প্রথম দরোজায় পৌঁছলো, দেখলো সেই এক পা-ওয়ালা খোঁড়া দৈত্যটাই এই দ্বাররক্ষী। দৈত্যটার নজর মালেক মুহাম্মাদের ওপর পড়তেই সে কাঁপতে শুরু করল। মালেক দৈত্যকে বলল ভয় পেও না, তোমার সাথে আমার কোনো কাজ নেই। তুমি শুধু আমাকে ওই ছয়টি দরোজা পেরুবার ব্যবস্থা করে দাও। দৈত্য বলল: তুমি পাঁচটা দরোজা পেরুতে পারবে কিন্তু শেষ দরোজা পেরুতে হলে কিছু গিফ্‌ট বা নজরানা নিয়ে যেতে হবে। ওই দরোজা পাহারা দেয় আমার ভাই। মালেক মুহাম্মাদ বলল: ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি করো! যেসব খোরমা আর হালুয়া নজরানা হিসেবে পেশ করো সেরকম কয়েক ট্রে ভর্তি করে নিয়ে আসো এবং গেইটগুলো পার হবার পাস বা গেইটপাস নিয়ে আসো।
দৈত্য ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি সবকিছু আঞ্জাম দিল। দৈত্য ওই গেইটপাস দেখিয়ে দেখিয়ে পাঁচ পাঁচটি দরোজা পার হয়ে গেল। সর্বশেষ দরোজায় গিয়ে গেইটপাস দেখালেও প্রহরী দৈত্য বলল: মিষ্টি ছাড়া গেইট পার হওয়া সম্ভব না। মালেক মুহাম্মাদ দৈত্যকে বলল: মুখ খোলো। দৈত্য মুখ হা করতেই মালেক তার সঙ্গে নিয়ে আসা হালুয়া আর খোরমাহগুলো মুখের ভেতর ঢেলে দিল। দৈত্য বলল: তোমার মিষ্টিগুলো তো মন্দ না। ঠিক আছে,যাও। মালেক মুহাম্মাদ অনুমতি পেয়েই সোজা ঢুকে গেল পরীদের বাদশাহর মেয়ের রুমে।
রুমে ঢুকে মালেক এদিক ওদিক তাকালো। খাটের ওপর নজর পড়তেই দেখলো পরীরাজ কন্যা ঘুমিয়ে আছে। আর তার মাথার উপরে ঝুলানো আছে সোনার খাঁচা। আর খাঁচার ভেতর বসে আছে সুন্দর ময়না পাখিটা। চারপাশে চারটি চেরাগ মানে টেবিল ল্যাম্প জ্বালানো আছে। প্রত্যেকটা ল্যাম্পের জায়গা পাল্টিয়ে দেওয়া হলো। এরপর একটা চিঠি লিখলো মালেক মুহাম্মাদ। চিঠিটা সে পরীরাজ কন্যার মাথার ওপর রাখল। চিঠিতে লেখা ছিল: হে পরীরাজ কন্যা! আমি মালেক মুহাম্মাদ, সোনার খাঁচা আর ময়না পাখিটা নিয়ে গেলাম। তুমি যদি চাও তাহলে কষ্ট করে এসো এই ঠিকানায়। ঠিকানায় তার দেশের নাম এবং রাজ প্রাসাদের কথা লিখে দিল। এরপর মালেক মুহাম্মাদ রওনা হয়ে গেল তার গন্তব্যে।
যেতে যেতে মালেক একেবারে শহরের বাইরে পৌঁছে গেল। তার সঙ্গে আসা কবুতররূপি পরীও এলো তার সঙ্গে সঙ্গে। পরী যখন দেখলো মালেকের হাতে সোনার খাঁচা আর ময়না পাখি, ভীষণ খুশি হয়ে গেল সে। এবার পরী পুনরায় বিরাট একটা পাখিতে পরিণত হলো এবং তার পাখায় চড়ে বসলো মালেক মুহাম্মাদ। পাখি আবার উড়াল দিল। উড়তে উড়তে গিয়ে পৌঁছলো পরীদের কেল্লায়। সেখানে মালেক মুহাম্মাদ রেখে এসেছিল দরবেশের দেওয়া লাঠি, দস্তরখান এবং তার ঘোড়া। সেসব নিয়ে পরীসহ ফিরে গেল সেই বাদশার শহরে যে বাদশাহর সাত কন্যাকে বিয়ে করেছিল তারা সাত ভাই। সেখানে দেখা হলো তার ছয় ভাইয়ের সঙ্গে। তাদের নিয়ে এবার মালেক মুহাম্মাদ যাত্রা শুরু করল।
যেতে যেতে গিয়ে পৌঁছলো ওই সেই শহরে যে শহরে ছিল এক পা-ওয়ালা দৈত্য, যে কিনা মানুষের কাছ থেকে চাঁদা নিত। সেই শহরের বাদশার প্রাসাদে গেল। পরদিন তার বৌসহ ছয় ভাই এবং তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালো। কিন্তু ছয় ভাই যখন দেখলো মালেক মুহাম্মাদের হাতে সোনার খাঁচা আর ময়না পাখি,ভাবলো মালেক যদি এই পাখি আর খাঁচা নিয়ে প্রাসাদে ফিরে যায় এবং তার বাবার হাতে দেয় তাহলে তো সে-ই হবে বাদশা। আর মালেকের বাদশা হওয়া মানে তার অধীনেই সারা জীবন কাটাতে হবে। কী করা যায় চিন্তায় পড়ে গেল ছয় ভাই। কোনো বুদ্ধি করতে না পারলেও মোটামুটি এই সিদ্ধান্ত নিলো যে কিছু না কিছু একটা করতেই হবে। মালেকের কাছ থেকে ওই খাঁচা আর পাখি কেড়ে নিয়ে তারাই তাদের বাবার হাতে দেবে যাতে তারাই হতে পারে পরবর্তী বাদশা।
যাই হোক ছয় ভাই ভাবতে ভাবতে মালেক মুহাম্মাদের সঙ্গে চলল এবং একসময় তারা গিয়ে পৌঁছলো একটা কুপের তীরে। ভাইদের একজন বলল: কেউ একজন যাও পানি নিয়ে আসো। মালেক বলল: ঠিক আছে,আমি যেহেতু সবার ছোট,সুতরাং আমিই যাচ্ছি পানি আনতে। এই বলেই সে চলে গেল কুপের ভেতর এবং পানির বালতি পূর্ণ করে উপরে পাঠালো। মানুষেরাও পানি খেল এবং ঘোড়াগুলোকেও খাওয়ানো হলো। সবার পানি খাওয়া হলে মালেক মুহাম্মাদ বালতিতে চড়ে বসলো যাতে তাকে টেনে উপরে তোলা হয়। কিন্তু তখনই ঘটলো দুর্ঘটনা। (ক্রমশ..)
‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (৯)
হ্যাঁ ভাইয়েরা ঠিকই বালতি উপরে তোলার জন্য সূতা ধরে টানতে লাগলো। কূপের প্রায় অর্ধেকটায় আসার পর তারা দড়িটা কেটে দিল এবং মালেক মুহাম্মাদ নীচে পড়ে গেল। ভাইয়েরা এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল এবং নিজ নিজ স্ত্রীকে নিয়ে তারা নিজেদের শহরের দিকে রওনা হলো। স্ত্রীদের হুমকি দিয়ে বলল: কেউ যদি এই ঘটনা কোনোক্রমে অন্য কারো কাছে ফাঁস করে তাহলে তাকে মেরে ফেলা হবে। মহিলারা ভয়ে নিজেদের মুখে কুলুপ আঁটলো। সবাই সবাইকে সতর্ক করে দিল: খবরদার একদম চুপ, টু শব্দটিও করবে না।
মালেক মুহাম্মাদ কূপের ভেতর পড়ে বেহুশ হয়ে যায়। যখন তার হুশ ফিরে আসে সারা শরীর তারা ব্যথা করতে শুরু করে। সে উপরে কূপের মুখের দিকে তাকায়। দেখতে পায় একটা লোক কূপের মুখে দাঁড়িয়ে আছে এবং থেকে থেকে তার দিকে তাকাচ্ছে। লোকটা বালতি ভেতরে ফেলল পানি তুলতে। মালেক মুহাম্মাদ এই সুযোগে বালতির ভেতর বসে পড়তে চাইলো যাতে উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু লোকটা যখন মুহাম্মাদকে দেখলো বলল: তোকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি বল্ কে তুই? আমাকে পানি দে। তুই বিনিময়ে যা চাস তাই পাবি। মালেক বলল: আমি কিছুই চাই না,শুধু কূপ থেকে আমাকে উপরে তোলো! লোকটা মেনে নিল এবং মালেকও লোকটার জন্য পানি পাঠাল।
কূপের ভেতর থেকে উপরে উঠে এসে মালেক লোকটার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করলো: কে তুমি!
লোকটি বলল: আমি একজন ব্যবসায়ী। ভারতে গিয়েছিলাম এখন ফিরে যাচ্ছি নিজ শহরের দিকে। তুমিও চলো আমার সাথে। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো চিকিৎসার জন্য। মালেক মুহাম্মাদ রাজি হয়ে গেল এবং লোকটার সঙ্গে যেতে উদ্যত হলো। পা বাড়াবার আগে কূপের চারপাশে একবার নজর বুলাতেই দেখলো তার দস্তরখান, পাত্র আর লাঠি পড়ে আছে কূপের পাশে। ভাইয়েরা যেহেতু এগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতো না সে জন্য ভাবছিল পুরোণো জিনিসগুলো হয়ত মূল্যহীন। সেজন্য তারা জিনিসগুলোকে সেখানেই ফেলে রেখে চলে গেছে। মালেক মুহাম্মাদ সেগুলোকে একত্রিত করে ব্যবসায়ী লোকটার সঙ্গে রওনা হয়ে গেল।
পাঠক! আপনাদের কি মনে আছে দরবেশের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে মালেক মুহাম্মাদ এই জিনিসগুলো মানে দস্তরখান, লাঠি এবং একটি পাত্র নিয়েছিল তার ঘোড়া আর তলোয়ারের বিনিময়ে।
মালেক মুহাম্মাদ তখন জিজ্ঞেস করেছিল: এগুলোর বৈশিষ্ট্য কী?
দরবেশ বলেছিল: পাত্রটা হাতে নিয়ে যত মেহমানই তোমার আসে শুধু ভেতরে হাত রেখে বলবে: হে সোলায়মান নবী! আমার মেহমান আছে। এরপর পাত্র থেকে যতই খাবার নেবে কমবে না। দস্তরখানের বৈশিষ্ট্য হলো এটা বিছিয়ে সোলায়মান নবীকে স্মরণ করে বলবে আমার মেহমান আছে। তারপর যতই রুটি নেবে শেষ হবে না। আর লাঠিটা হাতে নিয়ে বলবে: আমি অমুকের মাথাটা চাই। অমনি মাথাটা লাউয়ের মতো কাটা হয়ে যাবে।
কিন্তু মালেক মুহাম্মাদের ভাইয়েরা এসব জিনিসের বৈশিষ্ট্য না জানার কারণে কোনো গুরুত্ব না দিয়েই ফেলে রেখে চলে যায়। আর মজার ব্যাপার হলো এইসব জিনিস দিয়েই মালেক মুহাম্মাদ সকল বিপদ থেকে উদ্ধার পায়। ভাইদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায় এবং তার পিতাও সেসব বুঝতে পারে। অবশেষে যে যার মতো পরিণতি আর পুরস্কার লাভ করে। বাদশা যে স্বপ্ন দেখেছিল সে স্বপ্নের কথাটা নিশ্চয়ই মনে আছে! স্বপ্নটা ছিল এরকম: বাদশার মাথার ওপরে ঝুলছে একটি সোনার খাঁচা। খাঁচার ভেতর বসে আছে চমৎকার একটা তোতা পাখি। ঘুম ভেঙে যাবার পর বাদশা চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবছিল এই সোনার খাঁচার মানে কী কিংবা ওই তোতা পাখিরই বা কী অর্থ। অর্থ যা-ই হোক বাদশা কিন্তু ওই তোতা পাখির প্রেমে পড়ে গেছে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর থেকেই ভাবতে শুরু করেছে কী করে ওই তোতা পাখি আর সোনার খাঁচা হাতে পাওয়া যায়।
অপরদিকে বাদশাও কিছুদিন থেকেই ভাবছিল বাদশাহির দায়িত্ব কোনো এক ছেলের হাতে সোপর্দ করবে যাতে তার অবর্তমানে বাদশাহি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না দেখা দেয়। স্বপ্ন দেখার পর বাদশা ভাবলো:ভালোই হলো। এবার সাত সন্তানকেই পরীক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সাত সন্তানের মধ্যে যে সন্তান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তার হাতে বাদশাহীর দায়িত্ব দিয়ে দেবে। মালেক মুহাম্মাদ সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। সোনার খাঁচা আর ময়না পাখি ছয় ভাই নিয়ে এলেও পরক্ষণেই ভাইদের সকল অপকর্মের কথা জানতে পেরে বাদশা। তাই বাদশা শেষ পর্যন্ত মালেক মুহাম্মাদকেই তাঁর পরবর্তী বাদশা ঘোষণা করেন আর ছয় ভাইকে করেন তিরস্কার। #

বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৯

মা জননী

            আল মাহমুদ বিপ্লব

মায়ের সাদা কাফন

(৩০ শে জুলাই,২০১৮ ইং, সুবহে সাদিকের সময় আমার প্রিয় মা চলে যায় চিরতরে।তাঁরই স্মরণে নিচের লেখাটি। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি প্রিয় জননীকে)
♦♦♦♦♦♦♦♦♦♦
অনেকদিন আগে ইউটিউবের ইসলামিক সংগীতের একটি চ্যানেল থেকে নিচের গানটি শুনেছিলাম, মায়ের কথা মনে পড়ার সাথে সাথে গানটি আবারও মনে পড়লো-
"পৃথিবীর একপাশে মাকে রেখে,
অন্য পাশেও মাকে রাখি।
পৃথিবীর সব কথা ভুলে গিয়ে,
ব্যাকুল প্রাণে মাকে ডাকি।
জীবনের সবখানে, সবগানে,
মাকে ছাড়া জীবনের নেই মানে।
মা হীন এলোমেলো হৃদয়ে,
আর কোন ঠিকানা কেউ কি জানে।"
সত্যি! মা ছাড়া কেউ মনের কথা বুঝে না,বুঝতে পারে না। মানুষ মরণশীল।এটা মেনে নিতেই হবে।সবকিছু কবরস্থ করা যায় না।
কিছু কিছু মৃত্যুর বেদনা ভুলা যায় না।
আমি সবাইকে ভুলতে পারলেও,সব স্মৃতি ভুলতে পারলেও, আমার মায়ের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোকে কোনোদিনই ভুলতে পারবো না। আমার মায়ের সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে । সেসব স্মৃতির পাতা থেকে কিছু লেখা আপনাদের সাথে শেয়ার করে মনটাকে হালকা করতে চাই। আমি কেন মায়ের জন্য এতো পাগল তা নিচের কয়েকটি ঘটনা পড়লেই বুঝতে পারবেন।
#আমার মনে পড়ছে একদিন মা বলেছিল, আমার বড় ভাই ১৯৮৫ সালে মারা যাওয়ার পর মা ভূমিষ্ট করে দুটি মেয়ে ,তারপর ৪ বছর পর আমাকে ও ৭ বছর পর ছোটবোনকে ভূমিষ্ট করে । আমি ভূমিষ্ট হওয়ার আগে মা মান্নত করে বলেছিল,"আমার আবার একটি ছেলে হলে যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন আল্লাহর কাছে সপ্তাহে ১ টি করে নফল রোযা পালন করবো।
কথায় নয় বাস্তববিকভাবে তা করেছিল, মা আমার জন্য দীর্ঘ ২৫ টি বছরের প্রতিটি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দিন নফল রোযা পালন করেছে।
মাকে বলতাম,মাগো এত রোদ্রে রোযা রেখো না,শরীর খারাপ করবে,মা হেসে বলতো আরে বোকা ছেলে কিচ্ছু হবে না।বলতো এ নিয়ে তুই ভাবিস না,ঠিক মতো পড়াশোনা কর।
#আমাদের একসময় ভালো আর্থিক অবস্থা ছিল।পরে অভাবের সংসার হয়,
যার কারণে আমাদের চার ভাইবোনদের সব চাহিদা বাবা পূরণ করতে পারতো না। মা অনেক কিছু ত্যাগ করে আমাদের সব চাহিদা পূরণ করতো।
মনে পড়ে ২০০৩ সালে একদিন বায়না ধরেছিলাম- আমাকে মকমলের কাপড় কিনে দিতে হবে, না হলে স্কুলে যাবো না।সেসময় মকমলের কাপড় অনেক দামী ছিল। সেটার দাম ছিল ৩৮০০ টাকার মতো।
বাবাকে বলা মাত্রই বলেছিল, চুপ থাক,বেশি প্যাঁচাল পারবি না।টাকা নাই দিতে পারমু না।
মা তা দেখে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল,আমি মকমল কাপড় কিনে দিবো তোকে, স্কুলে যাওয়া বাদ দিবি না। সত্যি! মা,সেদিন ছাগল বিক্রি করে আমাকে মকমলের কাপড় কিনে দিয়েছিল। অথচ মায়ের পরনে তেমন ভালো কাপড় ছিল না।আমি বলেছিলাম,মাগো! তুমি একটা কাপড় কিনে নিয়ো।মা বলেছিল,আমার অনেক কাপড় রয়েছে।নিজের জন্য কোনদিন ভালো কোনো কাপড় কিনেনি।যা করতো সব আমার জন্য।মাঝেমধ্যে জোর করে নতুন কাপড় কিনে দিতাম। আজো মায়ের দেওয়া মকমলের কাপড়টি যত্ম রেখে দিয়েছি। দেখামাত্রই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না।
#মা শিখিয়েছে ধার্মিকতা।
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি আল্লাহ ও রাসুল, মসজিদ,নামাজ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতাম না।
মা আমাকে কুরআন তেলওয়াত শিক্ষা দিয়েছিল। আমি একটু জেদি ছিলাম, টাকা ছাড়া স্কুলে যেতাম না। মা বলতো,নামাজ পড়লে ফেরেস্ততারা সদাই খেতে টাকা দেয়।নামাজ পড়ার পর জায়নামাজের নিচে মা পাঁচ টাকা রেখে দিতো, যেন নামাজ পড়ি।আমি পরে বুঝেছি যে মা টাকা রেখে দিয়েছিল।
মাগো! আমি সত্যি! ধন্য যে তুমি আমাকে নামাজী বানিয়েছো।
#মা আমাকে শিখিয়েছিল মানবতাবোধ।উদ্ধুদ্ধ করেছে মানব হিতৈষী কাজে।একদিন বালিজুড়ি হাইস্কুল মাঠে একজন পাগলির মৃত দেহ পড়েছিল। তার সর্বাঙ্গে ছিল পোকা, দেহ ঘায়ে ভরা। কেউ তাকে গোসল করাতে চাইলো না।আমি সেদিন দেখেছিলাম আমার মা নিজহাতে পাগলটিকে গোসল করায়ে নিজ হাতে কাফনের কাপড় পড়িয়ে দেয়।অনেকেই তাকে হেলা করতে শুরু করে।মা বলতো,আমি ঠিক কাজ করেছি,এরকম সবারই করা উচিত।আমাকে বলতো,যখনই কারো বিপদ দেখবি সাধ্যানুযায়ী পাশে দাঁড়াবি।মাগো! আমি তোমার নিকট থেকে মানবতাবোধের বাস্তব চিত্র শিখেছি।
#আমার মায়ের দুটি বিশেষ গুণ ছিল, তিনি সুস্বাদু রান্না তৈরি ও অপরকে মেহমানদারিতে পরিতৃপ্ত হতেন।
।এমন নারী এ সমাজে এখনো কি আছে ?
আমি মনে করি তেমন নেই। আমার মা এজন্য সবার চেয়ে অনন্য ছিল। আমার মা এজন্য সবার মন জয় করেছিল।
এরকম হাজারো স্মৃতির পিরামডি তৈরি করে চলে গেলো মা।
পৃথিবীতে একটি নাম মা। নামটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য ও গভীরতা অনেক বেশি।
যে নামে রয়েছে অমৃত সুধা। যে নামের প্রশংসার কথা অবিরত লিখলেও শেষ হবে না।যে নামের দোয়ায় প্রভুর কাছে রয়েছে সফলতা ।
যে নামের বদদোয়ায় রয়েছে বিফলতা।
এ জীবনের সফলতা,বিফলতা নির্ভর করে পিতামাতার দোয়ার উপর। পৃথিবীতে প্রতিটি পিতামাতা তার সন্তানের নিকট মহাদামী সম্পদ।
এ সম্পদ দুটির যারা পরিপূর্ণ হক আদায় করে তারাই প্রকৃত সন্তান।পৃথিবীর বুকে পিতামাতার প্রতি সন্তানদের ভালবাসা ভিন্ন হলেও, সন্তানের প্রতি পিতামাতার ভালবাসা অভিন্ন।সন্তানের ভালবাসা লোক দেখানো হতে পারে,কিন্তু পিতামাতার ভালবাসা নিষ্কলুষ। মাতাপিতার দুজনের মধ্যে মায়ের মর্যাদা বেশি। কেননা,মা সন্তানকে পেটে ধারণ করে, কষ্ট ভোগ করার পর প্রসব করে, তারপর অনেক প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে সন্তানকে গড়ে তুলে। পৃথিবীতে সেই তো হতভাগ্য যার মা নেই। আমিও তেমন একজন হতভাগ্য।
★৩০/৭/১৮ ইং আমার জীবনে একটি বেদনাবিধুর তারিখ, সেই তারিখের রাত-২:৩০ ঘটিকার সময় আমাদের চার ভাইবোনকে কাঁদিয়ে মা চিরদিনের জন্য চলে যায় না ফেরার দেশে। মা,অনেকদিন যাবত তিনটি কঠিন মরণব্যাধিতে ভুগছিল,কিন্তু মুখ খুলে তা বলেনি। যখন তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে একদম অসহ্য হয়ে উঠেছিল তখন তিনি রোগের কথা বলেন। ততক্ষণে রোগ তিনটি নিরাময়ের বাইরে চলে গিয়েছিল। তারপরেও তা শুনামাত্রই আমরা তাকে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করা শুরু করি। মাদারগঞ্জ, জামালপুর,বগুড়া,ঢাকার নামকরা হাসপাতালসহ আরো অনেক জায়গায় নিয়ে যায়। এসব প্রতিটি জায়গায়  আমার বড় বোন,মেঝো বোন,হাকিম ভাই, এরশাদ ভাই, রিক্তা ভাবি ও বড় মামীর ভূমিকা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি।
যাহোক,যেখানেই গিয়েছি প্রচুর টাকা খরচ আর চিকিৎসার নামে টেষ্ট বাণিজ্যে পড়েছি। কিন্তু রোগীর তেমন ট্রিটমেন্ট তারা করেনি।যা করেছে ডাক্তারেরা তা দ্বারা ওরা টাকা লুটে নিয়েছে। ডাক্তারেরা যে কি পরিমাণ মানবতাবিরোধী তা বুঝতাম না, যদি বিপদে না পড়তাম।সর্বশেষে মাকে নিয়ে গেলাম বাংলাদেশের
সর্বোচ্চ চিকিৎসালয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ১ মাস  থাকার পর একেরপর এক টেষ্ট করা শেষ করে তারা ফাইনাল রির্পোট দিলো যে, আমার মা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার বাঁচার সম্ভাবনা নেই। ডাক্তারেরা রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে দিলো । দৌড়াদৌড়ি ও অনেক টাকা খরচ,ত্যাগ-তিতিক্ষা করেও কোনরুপ কাজ হলো না। ব্যর্থ মনোরথে মাকে আগের তুলনায় আরো বেশি মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে নিয়ে এলাম। প্রচন্ড ব্যথায় মা তখন ছটফট করছে। অজস্র মানুষ মায়ের জন্য দোয়া করলো। তাঁর অসুস্থতা আরো তীব্র হতে লাগলো এক পর্যায়ে কথায় বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিলো , এমন পরিস্থিতেও তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করে দিলো।
চার ভাইবোনকে একত্রিত করে সবাইকে শেষ আদর করে দিলো আর বাকি সময় আল্লাহু নামের জিকির করতে করতে চললো তিনটি দিন। এক পর্যায়ে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল পরপারে। আমাদের ভাইবোনকে চির ইয়াতীম করে চলে গেল মা। চোখের সামনে ছটফট করে মা মারা গেল, চার ভাইবোন তেমন কিছুই করতে পারলাম না। এখানে সবাই অসহায়, নির্বাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কেননা,বিধাতার বিধান, না মেনে কোন উপায় নাই। শেষ বিদায় জানিয়ে মাকে রেখে এলাম নির্জন নিরালায় একলা অন্ধকার ঘরে। মা আর কোনদিন আমাকে ভাত খেতে ডাকবে না আর খোঁজ নিবে না। মা যে চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে চলে গেল নিরব অভিমানে। মাগো,আমাদের চার ভাই-বোনকে মাফ করে দিয়ো, তোমার জন্য তেমন কিছুই করতে পারলাম না। তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না।আমরা নির্বাক হয়ে গেলাম বিধাতার বিধানের কাছে। এ এক নিঃসীম বেদনা।

শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৯

সী-মোরগ


সী-মোরগ: (১)
ইরানের ধ্রুপদী সাহিত্যে কিংবা রূপকথায় এই সী-মোরগ বিভিন্ন রূপে ও প্রতীকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে।
এক গরীব লোক তার বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে বাস করতো। কাজকর্ম ছিল না তার। ভবঘুরে জীবনযাপন করতো। কিন্তু এভাবে তো আর জীবন চলে না। অবশেষে তার স্ত্রী ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে গিয়ে একদিন তাকে বললো: “অনেক তো হলো! বেকার ঘুরে আর কতদিন কাটাবে। ভবঘুরে হয়ে কাটালে তো জীবন চলবে না। এভাবে কোনো ফায়দা নেই। বরং যাও! কাজকর্ম খুঁজে বেড়াও”! লোকটা ভাবলো কথা তো মন্দ না। বৌ তো ঠিকই বলেছে। বেচারা অগত্যা বেরিয়ে পড়লো কাজের খোঁজে। এখানে সেখানে কতখানে যে গেল, কোনো লাভ হল না। কাজের সন্ধান পেল না। কী করা যায়! এই বেকারমূর্তি কিংবা নিলাজ চেহারা কী করে বৌকে দেখানো যায়! ছি ছি করবে বৌ! বৌয়ের মুখের তিরস্কার কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না। শুনতে চায় না তার মুখনিসৃত পবিত্র সুখহানিকর বাণী।
বিষন্ন মনে লোকটা গেল সমুদ্রের দিকে। তীরে দাঁড়িয়ে ভাবলো এই অপয়া জীবনের কোনো মূল্য নেই। মূল্যহীন জীবন না রেখে বরং ওই সমুদ্রের পানিতে আত্মাহুতি দেয়াই শ্রেয়। বৌয়ের যন্ত্রণা আর তিরস্কার শুনতে হবে না। কাজের খোঁজে বেকার ঘুরে ঘুরে হতাশার সাগরে ডুবতে হবে না। এই সাগরে একবার ডুবে মরলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। এই ভেবেই সে সোজা নেমে গেল সমুদ্রের তরঙ্গময় পানিতে। কিন্তু ডুবে মরা কি এতই সহজ! না। ডুবতে গিয়েও ডুবতে পারলো না। কেবলি ভেসে উঠছিল তার শরীর। এমন সময় সমুদ্রের উপর থেকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল একটি সী-মোর্‌গ। সী-মোর্‌গ দেখছিল একটা লোক ডুবে মরার চেষ্টা করছে। সে দ্রুত নীচে নেমে এলো এবং তার নখের পাঞ্জায় লোকটাকে আটকে তুলে নিয়ে গেল পানি থেকে।
সী-মোর্‌গ আশ্চর্য এক পাখি। ইরানি রূপকথার জগতে বহুকাল ধরে বিচরণকারী এই পাখিটি অদ্ভুতরকমভাবে কথা বলতে জানে এবং মানুষের অবস্থাও বুঝতে পারে। আমরা তাই রূপকথার অন্যতম উপাদান এই পাখিটির নাম পাল্টাবো না, সী-মোর্‌গই বলবো। তো পাখিটি লোকটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখলো তার আপাদমস্তক হতভাগ্যে পরিপূর্ণ। সী-মোর্‌গ দ্রুত উড়ে গিয়ে সমুদ্র থেকে একটা বড় মাছ ধরে নিয়ে এলো এবং মাছটা লোকটার হাতে দিলো। লোকটা খুশি হয়ে মাছটা নিয়ে ফিরে যেতে মনস্থির করল নিজ শহরের দিকে। সেখান থেকে বাসার দিকে যেতে পথে দেখা হলো বদমাশ ধরনের এক লোকের সাথে। দুষ্ট লোকটার নজর পড়লো সুন্দর ওই মাছের ওপর। সে দশ সির আটার বিনিময়ে মাছটা নিয়ে নিতে চাইলো। প্রাচীন পরিমাপে দশ সির এখনকার এক কেজি’র চেয়ে কিছু কম,পৌনে এক কেজির মতো হয়। কিন্তু হতভাগ্য লোকটা তাতেই খুশি হয়ে মাছটার বিনিময়ে ওই দশ সির আটা নিয়ে নিলো।
আটা নিয়ে বাসায় ফেরার পর তার বৌ বললো: “এই কাজটা আরও আগে করলে কী হতো! প্রতিদিন এই পরিমাণ আটা নিয়ে এলেই তো চলে। বাচ্চাদেরও খিদে মিটে যায় আর কান্নাকাটি করে না”। বৌয়ের কথা শুনে লোকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভালোভাবেই ঘুমিয়ে কাটালো রাতটা। পরদিন আবার সে গেল বাজারের দিকে কাজের সন্ধানে। কিন্তু আজও কোনো কাজ তার ভাগ্যে জুটলো না। অবশেষে আবারও সে অভিশপ্ত এই জীবন ধ্বংস করার জন্য মানে আত্মহত্যা করার উদ্দেশে সমুদ্রের দিকে গেল এবং গতকালের মতোই পানিতে যুবে মরতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আজও সৌভাগ্যক্রমে ওই সী-মোর্‌গ এসে তাকে উদ্ধার করলো। গতকালের মতো আজও একটা মাছ ধরে এনে দিলো তাকে।

কিন্তু আজও একই ঘটনা ঘটলো। দুষ্ট লোকটা পথের মোড়ে বসে ছিল এবং সামান্য আটার বিনিময়ে মাছটা নিয়ে গেল। বাসায় ফেরার পর আজও তার স্ত্রী যখন দেখলো স্বামি তার খালি হাতে ফেরে নি তখন তাকে বললো: একেই বলে পুরুষ! প্রতিদিন সন্ধ্যায় এতটুকু আটা এনে দিলেই তো বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়,আর কোনো টেনশন থাকে না। লোকটা মানে মহিলার স্বামী কোনো উত্তর দিলো না। বললো না কোত্থেকে কীভাবে এই আটার ব্যবস্থা হচ্ছে। রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে আবারও এক বুক আশা নিয়ে শহরের দিকে গেল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাজারের অলিগলি দোকানপাট সর্বত্র ঘুরেও একটা ছোটোখাটো কাজও জোটাতে পারলো না। অগত্যা চলে গেল সেই আগের দিনের মতো সমুদ্রের দিকে। গভীর পানিতে নেমে ডুবে মরতে চাইলো।
ঘটনাক্রমে আজও সেই সী-মোর্‌গ এসে দেখলো সেই লোকটাই ডুবে মরতে চাচ্ছে। সী-মোর্‌গ ভাবলো এই লোক মনে হয় তার জীবনের ভার সহ্য করতে পারছে না। সুতরাং তার মরে যাওয়াই ভালো। যে বারবার মরে যেতে চায় তাকে উদ্ধার করার কী দরকার। এটা বোধ হয় লোকটার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই মরতে আসে। যাক মরুক গে,আমার কী! কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবলো: যদি সত্যি সত্যিই লোকটা মরে যায়! তাহলে কী হবে। এই ভেবে লোকটার দিকে তাকাতেই দেখলো লোকটা সত্যিই আত্মহত্যাই করতে চাচ্ছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এভাবে তার চোখের সামনে যদি কেউ মরে যায় আর সে যদি তাকে না বাঁচায় তাহলে তো তার মৃত্যুর জন্য সে-ই দায়ী থেকে যাবে! কারো মৃত্যুর দায়ভার সী-মোর্‌গ নিতে চায় না,তাই লোকটাকে আজও পানি থেকে তুলে নিয়ে বাঁচালো এবং আগের দিনগুলোর মতোই একটি মাছ তুলে এনে তার হাতে দিলো।
কিন্তু সী-মোর্‌গের মনে হলো এই হতভাগ্য বোধ হয় জানে না এই মাছের কী মাহাত্ম্য। সেজন্য বললো: নিজেকে কেন পানিতে ডুবিয়ে মারতে চাও? তোমাকে যে প্রথম মাছটি আমি দিয়েছিলাম ওই একটা মাছই তো তোমার সাত প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট ছিল! তারপরও কেন মরতে আসো?
সী-মোরগ: (২)
ইরানের ধ্রুপদী সাহিত্যে কিংবা রূপকথায় এই সী-মোরগ বিভিন্ন রূপে ও প্রতীকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। এক গরিব লোক সংসারের ভার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার আশ্রয় নিয়ে সমুদ্রে গিয়ে ডুবে মরতে চাইলে সী-মোরগ পরপর কয়েকবার তাকে উদ্ধার করে একটি করে মাছও তার হাতে দিয়ে দেয়। লোকটির কাছ থেকে ধুরন্ধর এক ব্যক্তি সামান্য আটার বিনিময়ে ওই মাছ নিয়ে নেয়।
তৃতীয়বারের মতো এই ঘটনা ঘটলে সী-মোরগ বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করে: তোমাকে যে প্রথম মাছটি আমি দিয়েছিলাম ওই একটা মাছই তো তোমার সাত প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট ছিল! তারপরও কেন মরতে আসো?

সী-মোরগের প্রশ্নের জবাবে এবার আত্মহত্যা করতে যাওয়া লোকটি বললো: প্রথম মাছটির বিনিময়ে সামান্য আটা নিয়ে বৌয়ের হাতে দিয়েছি। দ্বিতীয় মাছটিও সেরকমই সামান্য আটার বিনিময়ে নিয়ে নিয়েছে এক লোক। সেই আটায় রুটি বানিয়ে বাচ্চাদের দিয়েছি। এটা কি কোনো জীবন হলো? আমার কপালটা এমন কেন!
সী-মোরগ বললো: কপালের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তোমাকে যে মাছগুলো দিয়েছি সেগুলোর পেট ছিল সোনা-রূপায় ভর্তি।
শুনেই লোকটির বুক থেকে দীর্ঘ একটি শ্বাস বেরিয়ে গেল আকাশের শূন্যতায়। এবার যে মাছটি তার হাতে আছে ভালো করে সেটিকে ধরলো এবং ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
কিন্তু আজও পথের মোড়ে সেই প্রতারক ধোঁকাবাজ লোকটি তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। যখনই সে দেখতে পেল আরেকটি মাছ নিয়ে লোকটি বাসার দিকে ফিরছে সামনে এগিয়ে গিয়ে আগের মতোই বললো: দাও, মাছটা দাও আর তার বিনিময়ে এক মুষ্টি আটা নিয়ে যাও। প্রস্তাব শুনে লোকটি আজ হাসলো। প্রতারক লোকটি বললো: ঠিক আছে,দুই মুষ্টি দেবো। এবারও হাসলো। প্রতারক এবার তিন মুষ্টি,চার মুষ্টি.. এভাবে বাড়াতে লাগলো। কিছুতেই আজ লোকটি তার মাছ দিতে চাইলো না। প্রতারক লোকটি বুঝতে পারলো যে আজ কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে। বললো: ঠিক আছে এক হাজার দিনার দেবো,দাও।
লোকটা তারপরও মাছ বিক্রি করতে রাজি হলো না। এবার প্রতারক লোকটা মাছওয়ালার কলার টেনে ধরলো। শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি থেকে মারামারি।
মারামারির এক পর্যায়ে টহলরত পেয়াদারা এসে দুজনকেই ধরে নিয়ে গেল বাদশার দরবারে। বাদশাহ তাদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনা দেখে জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে তোমাদের? চীৎকার করছো কেন? জবাবে মাছ হাতে লোকটি বললো: হুজুর! তিনটি মাছ আমি পেয়েছি। মাছগুলোর পেট সোনারূপায় পরিপূর্ণ। ঘরে খাবার নেই। বাচ্চারা অভুক্ত। এই প্রতারক আমার কাছ থেকে পরপর দুদিন দুটি মাছ নিয়ে আমাকে প্রথমদিন দিয়েছে এক মুষ্টি আটা। দ্বিতীয় দিন একটি মাছের বিনিময়ে দিয়েছে সামান্য আটা। আজও সে এই তৃতীয় মাছটিও নিতে চায়। আমি দিতে চাচ্ছি না বলেই সে আমাকে মারার চেষ্টা করছিল।
বাদশাহ এবার আগের দুটি মাছ নিয়ে আসার জন্য আদেশ দিলেন। মাছগুলো নিয়ে আসার পর সেগুলোর পেট ফাঁড়তেই বেরিয়ে এল জ্বলজ্বল সোনারূপা। এগুলো দেখে তো বাদশাহ হতবাক। দুই ঠোঁটে আঙুল কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। মনে মনে বললেন: খোদার কী কুদরত! মাছের পেটে এতোসব সোনা-জহরত...!
বাদশাহ এবার লোকটাকে তার মাছগুলো বুঝিয়ে দিয়ে বললেন: সত্যি করে বলো তো! এই মাছগুলোর রহস্য কী! কোত্থকে এনেছো এগুলো? লোকটি এবার তার সাংসারিক দুরবস্থার বিবরণ তুলে ধরলো এবং বললো খাবার জুটাতে না পেরে সমুদ্রে ডুবে মরতে চেয়েছিল। সী-মোরগ তখন তাকে বাঁচিয়েছিল এবং পরপর তিনদিন সী-মোরগ তাকে একটি করে মাছ এনে দিয়েছিল তার হাতে। এসব শুনে বাদশা বললো: যাও! ওই সী-মোরগটাকে নিয়ে আসো আমার কাছে।
মাছগুলো ফেরত পেয়ে যতটুকু আনন্দিত হয়েছিল লোকটি এবার তারচেয়েও বেশি কষ্ট পেয়ে ব্যথা বুকে লালন করে খালি হাতে ফিরে গেল বাড়িতে। মনে মনে ভাবলো, হায় কপাল! ভাগ্য আমার উন্নতির পথে আবারও বিশাল পাথর এনে ফেলে রেখেছে। কী যে করি!
বাসায় ফিরতেই তার বৌ রেগেমেগে জিজ্ঞেস করলো: কী হলো আবার! খালি হাতে ফিরলে যে! আটা কই! লোকটি বললো: শান্ত হও বৌ! সব বলছি।
এই বলে যা যা ঘটেছিল সব ঘটনা বৌ সে খুলে বললো। সবশেষে বললো: বাদশাহ এখন আমাকে ওই পাখিটাকে মানে সী-মোরগকে তার কাছে এনে দিতে বললো। এখন কী করি বলো! আমি সী-মোরগকে কী করে ধরবো আর বাদশার কাছে নিয়ে যাবো!
কথা শুনে বৌয়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে ভাবতেই চাইলো না তার স্বামীর কপালে কী দু:খ এসে ভর করেছে। সে বরং ভাবলো যাক এবার বুঝি তার কষ্টের দিন শেষ হতে যাচ্ছে। তার চোখেমুখে সোনার ঔজ্জ্বল্য চকমক করতে লাগলো।
বেচারা লোকটি কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে সকালে সূর্য উঠতেই বাড়ি থেকে বের হলো। ভেবে কুল পাচ্ছিলো না কী করবে সে। একবার ভাবে এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাবে। তাতে অন্তত এই জটিল পরিস্থিতি আর মানুষগুলোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু তারচেয়ে সহজ বুদ্ধি হলো আগের সিদ্ধান্তে ফিরে যাওয়া মানে সমুদ্রে ডুবে মরা। হয়তো তাতে কোনো উপায় বেরিয়ে আসবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। সোজা সমুদ্রে গিয়ে ডুবে মরতে চাইলো। ঘটনাক্রমে আজও নেই সী-মোরগ আকাশে উড়ছিল। সে দেখলো লোকটি ডুবে মরার চেষ্টা করছে। ভাবলো এর বদ অভ্যাস হয়ে গেছে। লোভে পেয়েছে ওকে। মরুক গে। এরকম মানুষের মরে জাহান্নামে যাওয়াই ভালো।
সী-মোরগ আর নীচে এলো না। উপর থেকেই দেখছিলো। যখন দেখলো বিশাল বিশাল ঢেউ তার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সী-মোরগ ভয় পেয়ে গেল এবং নীচে নেমে এসে তাকে উদ্ধার করলো এবং বললো: আবারও মরতে এসেছো তুমি? যাও! মরতেই যদি চাও এমন জায়গায় গিয়ে ডুবে মরো যেখানে আমি তোমাকে দেখতে পাবো না। লোকটি: আমি মাছের লোভে আসি নি। কেন এসেছি শোনো। এই বলে বাদশার পুরো ঘটনা সী-মোরগকে খুলে বললো।#
সী-মোরগ: (৩)
লোকটির সমস্ত ঘটনা শুনে সী-মোরগ আশ্চর্য হয়ে যায়। ভাবতে পারছিলো না কী করবে সে। মনে মনে ভাবলো যদি বাদশার দরবারে না যায় তাহলে বাদশা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা লোকটাকে ধরে তার গর্দান নিয়ে নেবে।
আর যদি যায় তাহলে তার নিজের বাচ্চা দুটো ক্ষুধায় মারা যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলো লোকটার সাথেই যাবে বাদশার দরবারে। লোকটা নীচে পায়ে হেঁটে পা বাড়ালো বাদশার দরবারে আর কান্নারত সী-মোরগ শূন্যেই বাদশার প্রাসাদের দিকে চললো।
কিছুদূর যাবার পর দেখা হয়ে গেল বাদশার ছেলে মানে রাজপুত্রের সঙ্গে। রাজপুত্র বা শাহজাদা যাচ্ছিলো শিকার করতে। লোকটাকে দেখে শাহজাদা বললো: কোথায় যাচ্ছো। লোকটা রাজপুত্রের প্রশ্নের জবাবে তার জীবনকাহিনী শুনিয়ে দিয়ে বললো: অনেক কষ্টে ওই সী-মোরগকে রাজি করিয়েছি প্রাসাদে যেতে। কিন্তু সমস্যা হলো সী-মোরগের দুটি বাচ্চা আছে। সে যদি এখন প্রাসাদে যায় বাচ্চা দুটো ক্ষুধায় মারা যাবে। সে জন্য সী-মোরগ ভীষণ উদ্বিগ্ন। বাচ্চাদের জন্য দুশ্চিন্তায় কাঁদছে সে। শাহজাদা সী-মোরগের চোখে অশ্রু দেখে কষ্ট পেলো। লোকটাকে বললো: তুমি সী-মোরগকে ছেড়ে দাও! রাজদরবারে গিয়ে বাদশাকে বলবে যে আমি সী-মোরগকে নিয়ে আসছিলাম কিন্তু শাহজাদার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার আদেশে আমি পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছি যেন সে বাসায় ফিরে গিয়ে বাচ্চা দুটোকে খাবার দেয়।
সী-মোরগ শাহজাদার নম্রতায় খুশি হয়ে তাকে তার দুটো পালক উপহার দিয়ে বললো: যখনই কোনো সমস্যায় পড়বে এবং সমাধানের কোনো কূলকিনারা পাবে না তখনই এই পালক আগুন দিয়ে পুড়বে আর তখনই আমি এসে হাজির হয়ে যাবো। এই বলে পাখি উড়ে চলে গেল তার বাচ্চাদের কাছে। শাহজাদা তার ঘোড়ায় চড়ে গেল শিকারের সন্ধানে আর লোকটা গেল রাজদরবারের দিকে। রাজদরবারে খালি হাতে যাওয়ায় বাদশাহ ভীষণ ক্ষেপে গেল। লোকটা বাদশাকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করার পর বাদশা এবার ক্ষেপলো শাহজাদার ওপর। বললো: এই ছেলে দেখতে পারে না তার বাবার কাছে একটা সী-মোরগ থাকুক। ওর হাতে বাদশাহির ভার ন্যস্ত করলে কী করবে,কে জানে! শিকার থেকে ফিরে আসুক! সোজা জল্লাদের হাতে তুলে দিয়ে বলবো গর্দান কেটে ফেলতে।
দুদিন পর শাহজাদা ঠিকই ফিরলো শিকার থেকে। সোজা বাবার কাছে গিয়ে হাজির হলো। বাদশাহ সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলো: সী-মোরগকে ছেড়ে দিলে কেন? ওই পাখির পরিবর্তে এখন তোমাকে হত্যা করা হবে।
ছেলে বললো: তুমি আমার পিতা। তোমার যা খুশি করবার অধিকার আছে। তবে আমাকে একটু সময় দাও, মরবার আগে দুই রাকআত নফল নামাজ পড়ে নিই।
বাদশাহ অনুমতি দিলো এবং শাহজাদা দ্রুত চলে গেল প্রাসাদের ছাদের ওপর। সেখানে সে দু রাকাত নামাজ পড়লো। সালাম ফিরিয়েই সে সী-মোরগের দেওয়া একটি পালকে আগুন ধরাতেই সী-মোরগ উড়ে এসে হাজির হয়ে গেল। শাহজাদা বললো: বাদশাহ মানে আমার বাবা চাচ্ছে আমাকে হত্যা করতে। কারণটা হলো তোমাকে মুক্তি দেওয়া। সী-মোরগ এ কথা শুনেই তার পাখা বিস্তার করে দিলো। শাহজাদা পিঠে সওয়ার হলো এবং পাখি উড়ে গিয়ে সোজা পার্শ্ববর্তী শহরের একটি বাড়ির দরোজার পাশে পৌঁছে তাকে নামিয়ে দিলো।
শাহজাদা এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। দেখলো এক বুড়ি বসে আছে ভেতরে। বুড়িকে বললো: আমি এখানে নতুন এসেছি,অপরিচিত মানুষ, কাউকে চিনি না জানি না। কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। আপনার ঘরে কি এই রাতটা কাটানোর সুযোগ হবে? সকালেই চলে যাবো।
বুড়ি বললো: না, জায়গা নেই। আমার ঘরটা পাখির বাসার মতোই ছোট। কটা দুম্বার বাচ্চা গরু আর গাধার বাচ্চাও আছে।
শাহজাদা কটা সোনার কয়েন বুড়ির হাতে দিতেই বুড়ির অবস্থা পাল্টে গেল। বললো: আমার ঘরে বাদশার এক বাহিনীর জায়গা হবে। আমি একা বৈ ত নই। শাহজাদা গেল বুড়ির ঘরের ভেতর। সেখানে কয়েকদিন কাটালো। একদিন গেল শহরের ভেতরের কী খবরাখবর,জানতে। বুড়িকে জিজ্ঞেস করলো: তোমাদের শহরে কি দুজন বাদশাহ?
বুড়ি বলল: হ্যাঁ! বাদশাহ এবং শাহজাদি দুজনই এই শহরের নিরীহ লোকজনের শাসক। আমরা হলাম বেচারা জনগণ-খাজনা দিতে দিতেই জীবন শেষ। একবার খাজনা দিতে হয় বাদশাহকে আরেকবার দেওয়া লাগে তার কন্যাকে। শাহজাদা একথা শুনে বলল: হে মা! তুমি তো অনেক করেছো,এবার আমাকে নিয়ে চলো ওই শাহজাদির কাছে। বুড়ি বলল: নিয়ে যেতে পারি। তবে বাদবাকি তুমি সামলাবে। শাহজাদি যদি তোমাকে পছন্দ করে তাহলে তো আর কথা নেই। কিন্তু যদি তার পিতা মানে বাদশাহ এসে পড়ে তাহলে কিন্তু তোমার রক্ষা নেই,তোমার গর্দান যাবে। শাহজাদা বলল: সমস্যা নেই। ভাগ্যে যা আছে তাই ঘটবে।
বুড়ি বলল: ঠিক আছে নিয়ে যাবো তোমাকে, একেবারে শাহজাদির পালঙ্কের নীচে। তবে হ্যাঁ! তুমি রুমাল দিয়ে শাহজাদির হাত দুটো বেঁধে ফেলবে। যদি তোমাকে শাহজাদির পছন্দ না হয় রে বাপু! তাহলে কিন্তু খবর আছে! শাহজাদির চল্লিশজন নারী প্রহরী আছে, তারা তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ওই চল্লিশ প্রহরী প্রতিদিন সকালে শাহজাদিকে ফুল দিয়ে সাজায়। বুড়ি সব জানতো। কীভাবে এবং কখন শাহজাদির কাছে যাওয়া যাবে সেটা ভালো করেই জানতো বুড়ি। সে অনুযায়ী শাহজাদাকে ঠিকঠাকমতো শাহজাদির পালঙ্কের নীচে পৌঁছিয়ে দিয়ে বুড়ি চলে গেল। শাহজাদা সুযোগ বুঝে শাহজাদির হাত রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেলল। শাহজাদি তার কক্ষে যুবকের আগমন দেখে তার রক্ষীদের ডাকলো। #

#Omarfaruk

#Omarfaruk