রবিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৯

*** ভাঙ্গা পিয়ালা ***


                  এম.ড়ি শিমুল
পড়ার অনুরোধ রইলো। ভালো লাগবে আশা করি।
-----আমি যে দেশে থাকি, প্রথমই সে দেশের ভাষা দিয়েই শুরু করি। " UTHANDO " (উঠান্ডো) ইহা একটি দক্ষিণ আফ্রিকার খুবই জনপ্রিয় "JULU " শব্দ। এর আগে আমাকে বলতে হবে "JULU" কি?
----- "JULU " হচ্ছে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর নাম। আমি যতটুকু জানি পৃথিবীতে দ্বিতীয়তম বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে " JULU " সম্প্রদায়। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে সাহসী ও শক্তিশালী গোষ্ঠীই হচ্ছে "JULU " গোষ্ঠী। আর এই "JULU " গোষ্ঠীর ভাষার নামই হচ্ছে "JULU " ভাষা। আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশেই এই JULU ভাষা ব্যবহৃত হয়।
-----যে ভাষায়ও কথা বলতেন বিশ্বের বর্ণবাদী বৈষম্যের লড়াকু বীর(নবেল বিজয়ী) লেনসন্স ম্যান্ডেলা, নবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু, প্রেসিডেন্ট তামামবেগি ও দুইবারের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাকোব জুমা সহ আরো অনেকেই।
-----UTHANDO, একটি julu শব্দ। যে শব্দের ইংরেজি অর্থ হচ্ছে LOVE, আর বাংলা অর্থ হচ্ছে ভালোবাসা।
-----আমি আমার দীর্ঘ ১২ বছরে এ দেশের মানুষের মাঝে " Real love " বলতে যে শব্দটি আছে, তা কোথাও দেখিনি। এখানে আছে শুধু নগ্নতার উন্মাদনা। এখানে কে কতটা বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে শারীরিক উন্মাদনায় মেতে উঠতে পারে তারই বাহাদুরি চলে নিত্যনতুন। এদের সূত্র মতে, নিত্যদিন কেন একই জামা পড়তে হবে? জামার মতো জীবনসঙ্গীর পরিবর্তন চাই।
-----যে যতো গার্লফ্রেন্ড বা বউ নিয়ে বেশি সন্তান জন্ম দিতে পারবে সেই হয় পুরুষ! আর বাকি সবই যেন কাপুরুষ।
-----গেন্না ধরে গেছে এদের এমন চিন্তাভাবনা দেখে। দোকানে আসে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঠিকই, কিন্তু নজর পড়ে অন্য নতুন শরীরে। একহাতে ঠিকই গার্লফ্রেন্ডের একহাত ধরে রাখে, অন্যহাতে নতুনের নতুন হাত। ফোন নাম্বার নিতে হয়ে পড়ে ব্যাকুল তারা। আর ফোন নাম্বার পেলে তো সবই বাজিমাত। অবশ্য নিজের গার্লফ্রেন্ডটি তখন গর্বের সহিতই বলে, তার বয়ফ্রেন্ডটি একটি পুরুষ।
-----অনেকদিন আগে কবিগুছের একটি লোক প্রায়ই আমার দোকানে আসতো বেশকিছু ডাইরিগুছের খাতা হাতে নিয়ে।
-----আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি এইসব?
-----ও, কবি কবি ভাবে গর্বের সহিত আমায় বলেছিল, আমি কিছু লিখি। সমাজ ও সমাজের মানুষকে জাগাতে চেষ্টা করছি।
-----আমি বলেছিলাম, কি লিখিস?
-----ও, বলেছিল, পুরুষ কি? কাহাকে বলে?
-----আমি জানতে চাইতেই সাহিত্যিক ভাবে বলে, যে মানুষ উপার্জনক করে বেশি গার্লফ্রেন্ড বা বউ নিয়ে বেশি সন্তান জন্ম দিয়ে সংসার চালাতে পারে সেই নাকি পুরুষ। আমি একজন লেখকের এমন চিন্তায় না হেসে পারিনি। এদের চিন্তার জগৎ টা কত ছোট্ট।
-----আমি সর্বতই দেখেছি এখানে হৃদয় ঘটিত কোন সম্পর্কই নেই। যা আছে তা যেন শুধুই শারীরিক। স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরাও এখানে একই রুমে রুমমেট হিসাবে থাকে রুমের ভাড়াটা সিয়ার করার জন্য। একই রুমে থেকে অবশ্য শারীরিক চাহিদাও সিয়ার করে রুমের ভাড়াটাও উসুল করে ফেলে। সেমিস্টার বা শ্রেণী বদলের সাথে সাথেই অবশ্য মানুষগুলোও বদলাতে ভুল করেনা তারা।
-----আমি এসব দেখে ঘৃণায় ভেবেছিলাম, এসবেই তাদের বসবাস। সবাই মনে হয় একই সুতায় গাঁথা। কিন্তু স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে যে কিছুটা ব্যতিক্রম থাকে তা প্রায় ভুলতেই বসেছিল আমি।
-----আজ একটি ঘটনায় আমার ১২ বছরের দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতাকে নিমিষেই মাটিচাপা দিয়ে চক্ষুকে খোলে দিয়ে গেলো।
-----আমি তখন ক্যাশ কাউন্টারে ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য টাকা হিসাব করতে ব্যস্ত। আমার বয়সী একজন নিগ্রো লোক ছলছল চোখে কাকুতি-মিনতি ভরা চোখে কিছু যেন বলতে চাচ্ছে আমায়।
-----আমি বললাম, কিছু বলতে চাস আমায়?
-----ও, বললো, হুম।
-----নতুন একটা ব্যাগ থেকে কি যেন একটা বের করবে এমন একটা ভাব। আমি অনেকটাই বুঝতে পেয়ে নাবোধক ইশারা করে বুঝিয়ে দিলাম যে, আমি নিবো না।
-----চোরের দেশ, এখানে প্রায়ই দোকানে কিছু না কিছু চোর তাদের চোরি করা জিনিস দোকানে বিক্রি করতে আসে। আমিও এমনটাই মনে করেছিলাম। আমি অবশ্য বরাবরই এসব থেকে দূরে থাকি। বলতে পারি, আমি অনেকটা ভয়েই থাকি এসব থেকে। বলতে পারেন, আমি একটা ভীতুরডিম। অবশ্য সস্তার যে দশ অবস্থা তা আমি মনে হয় ভালো করেই জানি।
-----ব্যাগ থেকে একটা ভাঙ্গা পিয়ালা বের করে আমাকে দেয়। আমি তো অবাক!
-----আমি বললাম, আজ বেশি খেয়েছিস নাকি (মদ)।
আমি এটা দিয়ে কি করবো?
-----ও, বলে, আমি এটা জোড়া দিতে চাই।
-----আমি বললাম, ওরে পাগল! একটা সুপারগ্লুর দাম পাচ Rand/ 35 taka. এরচেয়ে তো নতুনই একটা কিনতে পারবি।
-----ও, বলে, আমি এটাই জোড়া দিতে চাই।
------আমি পিয়ালাটা হাতে নিয়ে জোড়া দিয়ে দেখালাম। তাতে মনে হলো পুরোপুরিভাবে জোড়া লাগেনা। কিছু তো পান করা প্রশ্নই আসেনা।
-----আমি যখন পিয়ালাটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম, তখন হাতে যেন কিছু একটা আকাআকি উপলদ্ধি করতে পারছিলাম। আমি তখনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঐ আকাআকির মাঝে সুপ্তভাবে কি লুকিয়ে আছে?
-----ও, আমাকে বলে, তুই আমার এই ভাঙ্গা পিয়ালার সাথে অর্থের তুলনা করিস না। অর্থ দিয়ে এটার পরিমাপ করতে পারবিনা। এই ভাঙ্গা পিয়ালাটি আমার জীবনের চেয়েও দামী।
------ও, বলছিল আর চোখে অঝোর ধারায় জল ঝরাচ্ছিল। আমার আর বুঝতে বাকি রইলোনা। তাই ইশারাই বললাম, এটা বুঝি তোর ভীষণ স্মৃতির কারো দেওয়া পিয়ালা।
------ও কাদো কাদো ভাবে মাথা নাড়ছিল আর হাবোধক ইশারা করছিল। আমার ভিতরটা কেমন যেন মুচড় দিয়ে যাচ্ছিল ওর দিকে তাকিয়ে।
------আমি বললাম, এটা বুঝি তোর গার্লফ্রেন্ডের দেওয়া উপহার।
-----ওর মুখে একচিলতে হাসির রেখা অজান্তেই যেন ভেসে উঠেছিল, আবারো দমকা হাওয়ায় নিভু নিভু প্রদীপের মতো যেন আস্তে আস্তে নিভে গিয়ে কালো মেঘে ছেয়ে গেলো। আমি যেন তাই দেখে বুঝতে পারার শেষসীমানা অতিক্রম করে ওর হৃদয়ে সব সুপ্ত কান্নার কারণ আবিষ্কার করে ফেললাম।
------আর বেশি কিছু বলতে পারিনি ওর চোখের জলের কাছে নিজের ভালোবাসার আবেগটাকে পরাজিত করে। তাই তো ভীষণ যত্ন করে পিয়ালাটা নিজ হাতে পরিষ্কার করে সুপারগ্লু দিয়ে সুন্দর করে জোড়া লাগিয়ে দেই। ওর হাতে দিতেই পিয়ালাটি বুকে জড়িয়ে ও মুখে নিয়ে চুমা খেয়ে হুহু করে কেদে উঠে অবুঝ শিশুর মতো।
-----আমি ক্যাশ কাউন্টার থেকে বাহিরে এসে ওকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম ও জানতে চাইলাম সবকিছু।
-----Kwanele is my love. Kwanele is my life. but she is not around my earth. ও, বলে আর কেঁদেকেটে একাকার হয়ে গেলো। ওর কান্নায় আমার ধূসর অনউর্বর বুকের জমিন যেন সহসায় করুণ এক কুয়াশায় ভিজিয়ে দিলো।
-----ও, আমাকে সুপারগ্লুর দাম দিয়ে যেন তাড়াতাড়ি আমায় থেকে পালাবার জন্য একপ্রকার মরিয়া হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম, ওর এখন ভীষণ চিৎকার করে কান্নার প্রয়োজন। যা আমার সামনে কাদতে পারছেনা। এমন অবস্থায় আসলে চিৎকার করে কান্নাটা ভীষণভাবে জরুরি। চিৎকার করে কাদতে পারলেই 'ও' একটু শান্তি পাবে। একটু নিজেকে হালকা করতে পারবে।
-----কিন্তু এইসব বিষয়ে বরাবরই আমার একটু আগ্রহ বেশি কাজ করে। তাই বেহায়া মনটাকে শাসনের বেড়ী পরিয়েও মানিয়ে রাখতে পারিনি। যদিও আমারো বুকের মাঝে একপ্রকার সুপ্ত কান্নারা তখন সারেগামা বাজানো শুরু করেছিল।
-----আমি ওকে বললাম, আমি টাকাগুলো নিবোনা। আমিও তোর ভালোবাসার স্মৃতির সাথে স্মৃতি হয়ে থাকবো বলে অনেক যত্ন করে পিয়ালাটি জোড়া লাগিয়েছি। আমিও যে ভালোবাসাকে তোর মতো ভীষণ সম্মান ও শ্রদ্ধা করি। তোর স্মৃতির সাথে আমাকেও নয় একটু অংশীদার করে নে। কিন্তু তখনো জানিনা আসল ঘটনাটা কি?
----- আমি ভাঙ্গা ও জোড়া দেওয়া পিয়ালাটার ছবি তুলে রাখি ভালোবাসার স্মৃতির নির্দেশন স্বরূপ। এইসব কিছু করতে পেরে ভালোবাসার নতুন কোন ভাস্কর্য তৈরি করতে পারিনি বলে মনে না হলেও আমি যে ভালোবাসার স্মৃতির জন্য একটা ভাঙ্গা পিয়ালা জোড়া দেওয়ার স্বাক্ষী রয়ে গেলাম এটাও কম কিসের?আমাকে নেহায়েত ছোট কিছু মনে হয়নি তখন।
-----আমি সবকিছু জানতে চাইলে 'ও' বলতে শুরু করে:
-----আমি Kwanele কে খুব ভালোবাসতাম। আমরা এই অসভ্য সমাজে একটু ব্যতিক্রমভাবে ভালোবেসে বাচতে চেয়েছিলাম। আমরা আসলেই ব্যতিক্রমই ছিলাম। এই তো সাত মাস আগেই ভালোবেসে আমাকে এই পিয়ালাটি উপহার দিয়েছিল। যাতে লেখা আছে,
            Kwanele
      [ Kwaen-el-uh]
noun: most awesome &
World's greatest lover.
----আমি ওর জীবনে বিশ্ব বিখ্যাত ভালোবাসার মানুষ হয়েই এক সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিধাতা তা চাইলেন না। গত ছয়মাস আগে এক কার এক্সিডেন্টে Kwanele চলে যায় পরপারে আমায় একা ফেলে। আমি প্রায় এই ছয়মাসই পাগলের মতো ছিলাম। আজই প্রথম একটু মনে হয় স্বাভাবিক হতেই টেবিলে এই পিয়ালাটি দেখে অনেক আদর করে নাড়াচাড়া করতে ছিলাম। হঠাৎই হাত থেকে পড়ে ভেঙ্গে যায়।
-----কথাগুলো বলছে আর হুহু করে কাদছে লোকটি। আমার মাঝেও যেন কান্নার এক ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
-----ও, বলে,
Kwanele আমাকে ডাকছে। আমি আসি। আমার যে আর বেশি সময় নাই। আমি প্রায় স্বপ্নে ওকে দেখি।
ও, আমাকে প্রতিনিয়ত ডাকে। Kwanele বলে,
" I am alone here,
but I am wait for you longtime.
when you come here?
 I have a bed of rose.
I have a haven here,
this haven is a haven of rose.
-----আমি যাই, আমি যাই! ও, আমাকে ভীষণভাবে ডাকছে তাই।


 চোখ মুছতে মুতছে পাগলের মতো দৌড়ে চলে যায় আমার সামনে দিয়ে। আমি চেয়ে থাকি ভালোবাসার পাগলপারা নিগ্রো মানুষটার চলে যাওয়া পথের শেষসীমানার আশায়।
-----আমার চোখ থেকে অজান্তেই অবাধ্য কয়েক ফুটা বাঁধভাঙ্গা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে মাটির গায়। জানিনা, ভালোবাসার সম্মানে নাকি বিরহে গড়ায় আমার এ অশ্রুর? শুধু যে চোখের অশ্রুর গড়িয়ে পড়ার কথাছিল তাই পড়েছিল।
-----ভাবতেও অবাক লাগে, এই ভালোবাসার ভীষণ ক্ষরার দেশেও যে থাকতে পারে প্রকৃত প্রেমের প্রখর স্রোতধারা তা আমার জানা ছিল না।
-----মনেপ্রাণে সেলুট জানাই এমন প্রেমকে। তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়, "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়ায়ে দেখো তাই। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন"।
আমি মনে হয় প্রেমের অমূল্য রতনের সঠিক সন্ধ্যানই পেয়ে ছিলাম।
----তাইতো আমার মতো চুনোপুঁটি হয়েও এই ভাঙ্গা পিয়ালা নিয়ে কিছু লিখার বৃথা চেষ্টা করলাম মাত্র।
বি: দ্র: ভালো লাগলে দয়া করে লাইক ও কমেন্ট করে আপনাদের এমন লেখা প্রতিনিয়ত উপহার দেওয়ার উৎসাহ প্রদান করলে আমি উপকৃত হবো।

এম.ড়ি শিমুল, জোহান্সেবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

#Omarfaruk

#Omarfaruk